সময় দ্রুত চলে যাচ্ছে ;সন্তানের মনস্তত্ত্ব বোঝার চেষ্টা করুন
খালিদ বিন হাসান, জাহিন। ঢাকার নামকরা স্কুল- উদয়ন উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় এর ৮ম শ্রেণির ইংরেজি ভার্সনের একজন শিক্ষার্থী। গতকাল (১১ মার্চ ২০২১) বিকেল থেকে হারিয়ে যায়। জাহিনের আম্মা একজন সরকারি চাকুরে, এনসিটিবিতে কমর্রত। গতকাল রাত থেকে বেশ কয়েকবার আমার ফেসবুকের টাইমলাইনে এই খবরটি এসেছে, সন্তানকে ফিরে পাওয়ার আশায় অনেকেই বিষয়টি শেয়ার করেছেন।
এই জাহিনের হারিয়ে যাওয়া নিয়ে আমার মধ্যেও যথেষ্ট উদ্বেগ- উৎকন্ঠা ছিলো, জাহিনের সমবয়সী সন্তান আমারও আছে, হয়তোবা এর জন্য আমিও বিষয়টির খোঁজ নিতে থাকি। যাক- আজ (১২ মার্চ ২০২১) বিকেলেই আবার খবর পেলাম হারিয়ে যাওয়া জাহিনকে পাওয়া গেছে, শাসরুদ্ধকর- উৎকন্ঠার অবসান হলো। জাহিনের বাবা-মায়ের মনে প্রশান্তি ফিরে এসেছে। জাহিনের হারিয়ে যাওয়া এবং ফিরে পাওয়ার পেছনে বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর অকুন্ঠ সহযোগিতা ছিলো। এজন্য বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীকে তাঁদের চমৎকার কাজের জন্য ধন্যবাদ জানাই।
তবে জাহিনের হারিয়ে যাওয়ার ঘটনাটির পেছনে রয়েছে বেশ উৎকন্ঠা ও চিন্তার বিষয়। সমাজকে ভিন্নভাবে বিষয়টি চিন্তা করতে হবে। জাহিন, স্বচ্ছল পিতা-মাতার সন্তান। ঢাকার নামকরা স্কুলে পড়ে। পরিবারে বিত্ত-বৈভবের প্রাচুর্য কতটুকু আছে তা জানা না থাকলেও তার জন্ম ও বেড়ে উঠার পরিবেশ পরিবারে যে অভাব ছিলো না, এ বিষয়ে অনেকটা নিশ্চিত হওয়া যায় ।
সাধারণত আমরা ঘর থেকে ছেলে-মেয়েদের পালানোর যে ঘটনাগুলো শুনি বা জানি তার মধ্যে বেশিরভাগই পরিবারের আর্থিক অসচ্ছলতা, অভাব-অনটন থেকেই হয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে পারিবারিক অশান্তি কিংবা বাবা-মায়ের মধ্যেকার মনোমালিন্য থেকেও হয়ে থাকে। কিন্তু জাহিনের এই পালিয়ে যাওয়া কিংবা ঘর ছেড়ে যাওয়ার প্রেক্ষাপট একেবারে ভিন্ন বিষয়কে সামনে নিয়ে এসেছে-
জাহিনকে পাওয়ার পর জানা যায়, সে গতকাল মায়ের অফিসে (এনসিটিবি ভবন, মতিঝিল) এসে কাছেই আরামবাগ বালুর মাঠে যায় এবং এখানে গিয়ে সে আরামবাগ ঘরোয়া হোটেলে ম্যাসিয়ারের চাকুরি নেয়, চাকুরি নেয়ার শর্তই হলো- প্রতিদিন বিকেলে মাঠে খেলবে আর বাকী সময়টুকু হোটেলে কাজ করবে।
যা মাইনে পাবে তা দিয়ে খেলাধুলার সামগ্রী কিনবে এবং ভবিষ্যতে খেলোয়াড় হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করবে। শুধু তাই নয়- জাহিন এই হোটেলের ৩য় তলায় কর্মচারীদের জন্য নির্ধারিত আবাসিক কক্ষে (অনেকটা গণরুমের মতো) রাত কাটিয়েছে। একেবারে ভিন্ন থ্রিলার !
আমরা সন্তানকে প্রাচুর্য-চাকচিক্যের মধ্যে বড়ো করছি। সন্তানটি হোক আমার কিন্তু তারও ভিন্ন সত্তা রয়েছে, আমরা কেন যেন তা মেনে নিতে চাইছি না বা পারছি না। নিজের ইচ্ছা-অনিচ্ছা, সাধ-আহলাদ বাস্তবায়নের বড়ো ক্ষেত্র হয়ে যাচ্ছে আমাদের সন্তান। আর এই চাপিয়ে দেয়া স্বপ্ন বাস্তবায়নে অনেক ক্ষেত্রেই সন্তানের মধ্যে হতাশা কাজ করছে। আমাদের সন্তান কী হতে চায় কিংবা তার জীবন কেমন করে গুছাতে চায়, তা আমরা জানতেও চাই না।
আমরা শুধুমাত্র বুঝি সফল হওয়া, আর এই সফল হওয়াটাকে আবার আমরা পরিমাপ করি, একেবারে নিজের বানানো মানদন্ড দিয়ে। আর তা হলো কাড়ি কাড়ি টাকা, প্রাচুর্য। কতো কম সময়ের মধ্যে এগুলো অর্জন করতে পারবে, তাই হলো সফলতার মানদন্ড। এটি করতে গিয়ে প্রতিটি মানব শিশুর মধ্যে যে পৃথক সত্তা ছিলো, তাকে আমরা ধ্বংস করছি।
আজ আমাদের জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে উন্নতি হয়েছে। বাস-বাড়ি, রাস্তা, দোকান কিংবা শপিংমলে আলো-ঝলমল নিয়ন বাতি রয়েছে, রয়েছে প্রাচুর্যের ছড়াছড়ি কিন্তু সেই প্রাচুর্যের মাঝে নেই কোন প্রাণ । সব কিছু কেমন যেন মেকি, আলগা হয়ে যাচ্ছে। নগর জীবনের এপার্টমেন্ট যেন পৃথক পৃথক পাখির বাসা। একের সাথে অন্যের নেই কোন মিল, নেই ভাবের আদান-প্রদান।
এপার্টমেন্ট আমাদেরকে এপার্ট করে রাখছে। আজ আমাদের তৈরি নগরে শিশু-কিশোরদের তাদের মতো চলার কিংবা খেলাধুলা করার কোন বাড়তি উদ্যোগ নেই। আমাদের নগর শাসক কিংবা নগর পরিকল্পনাবিদ এ বিষয়টিতে নজর দিচ্ছেন না। আর আমাদের রাজনীতিবিদেরা, আমাদের শাসকেরা; সুযোগ পেলেই উন্নয়নের কথা বলেন, নগর সুবিধা আর গ্রামকে শহর বানানোর হরেক পরিকল্পনার কথা বলেন।
তাঁদের কথায় উন্নয়ন মানেই হলো- প্রশস্ত রাস্তা, ফ্লাইওভার, টানেল, নিয়ন বাতি, উচুঁ উচুঁ দালান, গড়ে উঠা নিত্য নতুন শপিং মল, সিনেপ্লেক্স আরো কতো কি। জায়গায় জায়গায় এতো এতো উচু দালান হয়েছে যে, এগুলো ভেদ করে সুয্যি মামাও মাঝে মাঝে পৌঁছাতে পারে না। কিন্তু সেই প্রাণহীন প্রাচুর্য্যর মাঝে যে সুখ নেই, শান্তি নেই- তা আমাদের উপলদ্ধিতে কবে আসবে ?
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ তাঁর লালসালু উপন্যাসে বলেছিলেন- ‘ধান দিয়া কি হইবো, মানুষের জান যদি না থাকে !’ আজ একবিংশ শতাব্দীতেও লালসালুর আবেদন ফুরিয়ে যায়নি।