চার মাসের শিশুর কাছে বাবা আর ফিরবে না
আগস্ট ০১ ২০২৪, ২৩:১৯
তুষার ইমরান, নিজস্ব প্রতিবেদক
চার মাসের শিশুটি জানে না তার প্রিয় বাবা চলে গেছে অজানা এক দেশে, অচেনা গন্তব্যে। বাবা আর কখনো ফিরবে না। সাত বছর বয়েসী সাইমুন বাবা বাবা বলে ডাকছে, বাবাকে না পেয়ে কাঁদছে। তার কান্নায় কাঁদছেন প্রতিবেশীরাও। শিশুটির বাবা প্রাইভেটকার চালক টিটু হাওলাদার। ঢাকার ধানমন্ডিতে কাজের জন্য বের হওয়ার সময় কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান তিনি।
আর্থিক অনটনের সংসার টিটু হাওলাদারের। স্বামী হারিয়ে স্ত্রী আয়েশা বেগম তিন শিশুসন্তান নিয়ে এখন দিশেহারা। বড় মেয়ে তানজিলার বয়স ১০, ছেলে সাইমুনের সাত ও ছোট মেয়ে তামান্নার বয়স মাত্র চার মাস। এখন কে দেখবে এই শিশুগুলোকে!
টিটু হাওলাদার বরগুনার বেতাগী উপজেলার হোসনবাদ ইউনিয়নের দক্ষিণ হোসনাবাদ গ্রামের আব্দুর রহিম হাওলাদারের ছেলে। মা রাশেদা বেগম সাপের কামড়ে মারা যান চার বছর আগে। টিটু হাওলাদার ঢাকার ধানমন্ডির সেন্ট্রাল হাসপাতালের চিকিৎসকের প্রাইভেটকার চালাতেন। হঠাৎ কল আসে চাকুরী নেই এমারজেন্সি লোক নিয়েছে। ফোনে ফোনে বদলি গাড়ি চালানোর অফার পেয়ে ঢাকায় জান টিটু। তার স্ত্রী আয়েশা বেগম জানান, কয়েকদিন আগে ছুটিতে বাড়ি এসেছিলেন, এসেই চাকুরী হারায় সে। গত ১১ জুলাই ঢাকায় যান, ঢাকায় মিলে বদলি গাড়ি চালানোর সুযোগ গ্রিন লাইফ হসপিটালের এক ডাক্তারের। এরই মধ্যে ১৯ জুলাই বিকেলে ফোন করে তাদের এক নিকটাত্মীয় জানান, তোমার স্বামীর গায়ে গুলি লেগেছে, মাথায় গুলি লেগে মগজ বের হয়ে গেছে। সে এখন ধানমন্ডির গ্রিন লাইফ হাসপাতালে আছে। আয়েশা বলেন, ‘আমার স্বামী একজন সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ। তিনি তো কোনো আন্দোলন করেননি। তাকে কেন জীবন দিতে হলো।’
পরদিন ২০ জুলাই রাতে টিটু হাওলাদারের ফুফাতো ভাই মো. রাকিব লাশ নিয়ে গ্রামের বাড়িতে আসেন। ওইদিন রাতেই জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়। আয়েশা বেগম বলেন, ‘ছেলেমেয়েরা বাবা বাবা বলে হয়রান হচ্ছে। ছেলে সাইমুন বাবার জন্য পাগল ছিল। ওকে কিছুতেই থামাতে পারছি না। শুধু তার বাবাকেই খুঁজছে। কয়েকদিন ধরে খাবার ও বুকের দুধও খাচ্ছে না। আমি অবুঝ সন্তানদের কী বুঝ দেব? খাওয়ার মতো ঘরে বাজার নেই। ঢাকায় যাওয়ার সময় আমাকে খালি হাতে রেখে গেছেন তিনি। বাচ্চাদের কীভাবে এখন বড় করব, আর বুঝে উঠতে পারছি না।’
বৃদ্ধ বাবা আব্দুর রহিম হাওলাদারকে দেখা গেল সন্তানের কবরের পাশে বিলাপ করছেন। বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন। সম্বিত ফিরলেই বলছেন, ‘এবার আমার ছেলে ঢাকায় যাওয়ার সময় বলেছিল, বাবা ওদের দেখে রেখ। এই ছিল আমার ভাগ্যে? আমার বুকের মানিক ছেলেকে পক্কির (পাখির) মতো গুলি করা হয়েছে। আমি আর অ্যাহন বেঁচে থেকে কী লাভ। তার অনেক স্বপ্ন ছিল, তা ভাইঙ্গা চুরমার।’
টিটু হাওলাদারের চাচাতো ভাই রনি হাওলাদার বলেন, ‘বাড়িতে লাশ নিয়ে আসার মতো টাকাও ছিল না। আমি একটি অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করি তার টাকা বন্ধু ও আত্মীয় স্বজনরা দিয়েছেন।
বেতাগী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান খলিলুর রহমান খান বলেন, ‘আমি ওই বাড়িতে গিয়েছিলাম। পরিবারটি খুবই অসহায়। আমার সাধ্যমতো আমি তাদের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করব। তবে সরকারিভাবে অসহায় এ পরিবারটির দায়িত্ব নেওয়া হলে টিটুর স্ত্রী ছেলে ও দুই মেয়ে নিয়ে বেঁচে থাকার পথ খুঁজে পাবেন।’