করোনার চিকিৎসায় বাংলাদেশে প্রথম রেমডেসিভির উৎপাদনকারী এসকেএফ
মে ০৮ ২০২০, ২০:৩২
দেশের জন্য সবচেয়ে ভালো খবর হলো করোনাভাইরাস প্রতিরোধে কার্যকর ওষুধ রেমডেসিভির উৎপাদন সম্পন্ন করেছে দেশের খ্যাতনামা ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান এসকেএফ ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড। উৎপাদনের সব প্রক্রিয়া শেষ করার এখন তারা বাজারজাত করার জন্য প্রস্তুত ।
এসকেএফের কর্তৃপক্ষ নিশ্চিত করেছেন, ‘করোনা পরিস্থিতি নিয়ে দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে তারা দেশবাসীকে এই সুখবর দিতে চায় যে বিশ্বে করোনার একমাত্র কার্যকর ওষুধ বলে স্বীকৃত জেনেরিক রেমডেসিভির উৎপাদনের সব ধাপ সম্পন্ন।’
করোনা ভাইরাস নিয়ে বিশ্ব জুড়ে যে মহামারীর হাহাকার, যে আতংক, যে আশংকা, সেখানে বিশাল এক আশা জাগিয়েছে এই ২৩ এপ্রিল। ২৩ এপ্রিল বৃটেনে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির তৈরি করোনা ভাইরাসের একটি টিকা মানুষের শরীরে পরীক্ষা শুরু হয়েছে। বৃটিশ সরকার এবং অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি ভীষণ সংকটের এই সময়ে বিশ্ববাসীকে আশার বানী শোনানোর জন্য কৃতজ্ঞতা জানাতেই হয়। সিএইচএডিওএক্স১ এনসিওভি-১৯ নামের ওই টিকাটি নিয়ে আশা জাগানিয়া সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণটি হলো- ইতিমধ্যে বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণীর ওপরে এটি প্রয়োগ করে স্াফল্য পাওয়ার কথা বলছেন বিজ্ঞানীরা। অক্সফোর্ডের বিজ্ঞানীরা ভ্যাকসিনটির ব্যাপারে এতটাই আশাবাদী যে, আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই এই টিকার সাহায্যে লক্ষ লক্ষ মানুষ মারণঘাতী করোনা ভাইরাসের আক্রমণ এড়াতে পারবেন বলে তাদের দৃঢ় বিশ্বাস।
প্রায় ৮ শতাধিক স্বেচ্ছাসেবী এই গবেষণাটিতে অংশ নিচ্ছেন। আমরা এখন সবাই জানি যে, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির ভ্যাক্সিনোলজি বিভাগের একদল গবেষক তিনমাসের চেষ্টায় এই টিকাটি আবিষ্কার করেন। গবেষক দলটির নেতৃত্বে আছেন অধ্যাপক সারাহ গিলবার্ট।
চীন থেকেও আসছে সুখবর। চীনের দুটি কোম্পানি তাদের আবিষ্কৃত টিকার পরীক্ষা করতে যাচ্ছে খুব শীঘ্রই। বেইজিং ভিত্তিক একটি কোম্পানি এবং উহান ভিত্তিক একটি কোম্পানি দুটি ভ্যাক্সিনের পরীক্ষামূলক প্রযোগ করতে যাচ্ছে। জার্মান সরকারও মানবদেহে করোনা ভাইরাসের টিকার পরীক্ষা চালানোর অনুমোদন দিয়েছে। BioNTech এবং Pfizer যৌথভাবে BNT162 নামের টিকাটি তৈরি করছে। এই দুটি সংস্থা যুক্তরাষ্ট্রেও এই ধরণের পরীক্ষা চালাবে। মানবদেহে করোনা ভাইরাসের আরেকটি টিকা পরীক্ষা করার উদ্যোগ নিয়েছে অস্ট্রেলিয়ায়ও। এই ধরণের পরীক্ষা চালানোতে বিশেষজ্ঞ প্রতিষ্ঠান Nucleus Network মার্কিন প্রতিষ্ঠান Novavax এর সঙ্গে যৌথভাবে এই সপ্তাহেই NVX-CoV2373 v নামের টিকার পরীক্ষামূলক প্রয়োগ শুরুর কথা আছে।
স্বাভাবিকভাবে প্রাথমিক পরীক্ষায় উৎসাহব্যঞ্জক ফল পাওয়ায় করোনা রোগীদের চিকিৎসায় মার্কিন প্রতিষ্ঠান গিলিয়েড সায়েন্সেস কোম্পানির তৈরি এই ওষুধ সারা বিশ্বে সাড়া ফেলে। যুক্তরাষ্ট্রের ওষুধ প্রশাসন (এফডিএ) গত সপ্তাহে করোনার ওষুধ হিসেবে রেমডেসিভিরকে ব্যবহারের অনুমোদন দেয়। জাপানের ওষুধ প্রশাসন ৭ মে থেকে ওষুধটি করোনা রোগীদের ওপর প্রয়োগের অনুমতি দিয়েছে।
এ অবস্থায় এসকেএফ-ই বিশ্বে প্রথম ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান, যারা জেনেরিক (মূল বা গোত্র) রেমডেসিভির উৎপাদন করতে সক্ষম হলো। এসকেএফের উৎপাদন করা রেমডেসিভিরের বাণিজ্যিক নাম ‘রেমিভির’। এসকেএফ জানিয়েছে, বিধি অনুযায়ী রেমডিসিভির নমুনা ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের অধীনস্থ ন্যাশনাল কন্ট্রোল ল্যাবোরেটরিতে জমা দেওয়া হবে এবং ছাড়পত্র ও বাজারজাতের অনুমতি পাওয়ার পর কিছু দিনের মধ্যেই ওষুধটি বিতরণ শুরু করবে এসকেএফ।
ঔষধ প্রশাসন গত মার্চ মাসে ওষুধটি ব্যবহারের অনুমতি দেয়। যেহেতু এটি একটি শিরায় দেওয়া ইনজেকশন, সে কারণে এর উৎপাদনে সূক্ষ্ম প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হয়। দুই মাস ধরে এসকেএফ-কর্মীদের নিরলস পরিশ্রমের ফলেই এত কম সময়ে এটা উৎপাদন করা সম্ভব হয়েছে।
করোনাভাইরাস বা কোভিড-১৯ রোগের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি কার্যকারিতা দেখিয়েছে রেমডেসিভির। গিলিয়েডের নিজস্ব পরীক্ষায় দেখা গেছে, এই ওষুধ ব্যবহারে রোগীদের অবস্থার উন্নতি হয়েছে। মানুষের শিরায় ইনজেকশন হিসেবে এই ওষুধ প্রয়োগ করতে হয়। রোগের তীব্রতার ওপর এর ডোজ নির্ভর করে। গুরুতর অসুস্থ রোগীদের জন্য ৫ অথবা ১০ দিনের ডোজ প্রয়োজন হতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কিছু হাসপাতালে ওষুধটি প্রয়োগ করে দেখা গেছে, খুবই সংকটাপন্ন রোগীর ওপর এটা কাজ করছে। রোগীরা দ্রুত হাসপাতাল ছেড়েছেন এবং ভাইরাসের ঘনত্ব ওষুধটি কমিয়ে আনতে পারছে। ওষুধটি নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন সংকটাপন্ন রোগীদের জন্য ভালো ফল দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে। যদিও এখন পর্যন্ত করোনাভাইরাস প্রতিরোধী কোনো ওষুধ শতভাগ কার্যকর, এমনটা বলা যাচ্ছে না। তবে রেমডেসিভির ভালো কাজ করেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ ও আমেরিকার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব অ্যালার্জি অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজেসের পরিচালক অ্যান্থনি এস ফাউসি হোয়াইট হাউসে এক আলোচনায় বলেন, করোনা থেকে দ্রুত সেরে ওঠার ক্ষেত্রে রেমডেসিভিরের ইতিবাচক প্রভাব পরিষ্কার। আর এই ওষুধ যেহেতু কাজ করছে বলে পরিষ্কার প্রমাণ মিলেছে, তখন তা দ্রুত মানুষকে জানানো নৈতিক বাধ্যবাধকতার মধ্যে পড়ে।
ইন্টারনেটে ঘাটাঘাটি করলে দেখা যায় সার্স ও মার্স ভাইরাসের বিরুদ্ধেও এটি ব্যবহৃত হয়েছে। মূলত শ্বাসনালিতে সংক্রমিত ভাইরাসের বিরুদ্ধে ওষুধটি তার কার্যকারিতা দেখিয়েছে। এই ধারণা সামনে রেখেই এটি করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে ব্যবহারে অনুমোদন দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও জাপান। বাংলাদেশেও এটি ব্যবহারে বাধা নেই। তিনি বলেন, করোনাভাইরাস শ্বাসনালিতে সংক্রমিত হয়। সেই কারণে রেমডেসিভির ব্যবহারে যে পরীক্ষাগুলো চালানো হয়েছে, তার ফলাফল আশাব্যঞ্জক। তবে এটি এখনো ‘পর্যবেক্ষণ’ ও ‘পরীক্ষামূলক’ পর্যায়ে আছে। তারপরও দেখা গেছে, এই ওষুধ ব্যবহার করা হয়েছে এমন রোগীরা অন্য রোগীর তুলনায় অন্তত ৪ থেকে ৫ দিন আগে সুস্থ হয়েছেন।
এসকেএফ ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড ৩০ বছর ধরে ওষুধ উৎপাদন করে আসছে। প্রতিষ্ঠানটি দেশের বাইরে ৩০টি দেশে ওষুধ রপ্তানি করে আসছে। দেশের জন্য এটা ভালো খবর। করোনাভাইরাসের যেখানে কোনো চিকিৎসা নেই, সেখানে এই ওষুধ বাংলাদেশে চলে আসায় স্বস্তিবোধ করা যায় ।