জেলেদের বয়স কাঠামো, শিক্ষা ও সামাজিক অবস্থান

জানুয়ারি ১৫ ২০২১, ১১:৩৩

Spread the love

ক) বয়স কাঠামো
বয়স কাঠামো কোন সমাজে একজন জেলের অবস্থান এবং ভ’মিকা নির্ধারণের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক। ভোলা জেলার জেলেদের বয়স কাঠামো বিভিন্ন প্রতিবেদনে বিভিন্ন বয়স ভিত্তিক দল যথা, ১৫-৩০ বছর (যুবক দল), ৩১-৫০ বছর (মধ্যম বয়স দল), ৪৫ বছরের উর্ধে (বৃদ্ধ বয়স দল) ইত্যাদির ভিত্তিতে নির্ধারণ করা হয়েছে। দেখা গেছে যে, মধ্যম স্তরের বয়স কাঠামো(৩১-৫০ বছর) ছিল সর্বোচ্চ ৪০% এবং বৃদ্ধ বয়স দল (৪৫ বছর এবং তদুর্ধ) ছিল সব চেয়ে কম (২৫%)। গবেষণা এলাকায় ৩৫% জেলে যুবক বয়স কাঠামোর (১৫-৩০ বছর) অন্তর্ভুক্ত ছিল। এর অর্থ হল, মাছ ধরার কাজে নিয়োজিত মানব সম্পদের বেশির ভাগই সবচেয়ে বেশি কর্মক্ষম বয়স কাঠামো অর্থাৎ ১৫-৪৫ বছর বয়স কাঠামো থেকে আসে যা এক্ষেত্রে নিয়োজিত মোট মানব সম্পদের ৭৫% এর যোগান দেয়।

খ) ধর্মীয় অবস্থা
গবেষণা অঞ্চলে ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের একচ্ছত্র প্রধান্য পরিলক্ষিত হয়েছে। প্রায় ৯৫% জেলে মুসলমান ধর্মাবলম্বী এবং বাকি ৫% জেলে হিন্দু। যদিও কিছু কিছু ক্ষেত্রে, বিশেষত দেশের মধ্যাঞ্চলে অনেক স্থানেই বৃহৎ সংখ্যক জেলে হিন্দু ধর্মাবলম্বী (জলদাস সম্প্রদায়), কিন্তু উপক’লীয় অঞ্চলে বেশীরভাগ জেলেই ইসলাম ধর্মাবলম্বী। এই পরিস্থিতি এটা প্রমাণ করে যে, মুসলমান জেলেরা বছরের পর বছর ধরে মাছ ধরা পেশায় যোগদান অব্যাহত রেখেছে যেখানে চিরাচরিত হিন্দু জেলেরা নিজেদের অন্যান্য পেশায় নিয়োজিত করেছে যার মধ্যে পার্শ্ববর্তী জেলাসমূহে স্থানান্তরও অন্তর্ভ’ক্ত।

গ) জেলেদের শিক্ষাগত অবস্থান
শিক্ষার বর্তমান পরিস্থিতি অনুসন্ধান করে দেখা গেছে ভোলা জেলার ৮.৩৩% জেলে নিরক্ষর। বেশিরভাগ জেলে (৪৫%) শুধুমাত্র স্বাক্ষর করতে পারে যা এই এলাকায় কিছু সংখ্যক এনজিওর শিক্ষা বিস্তার কার্যক্রমের ফল বলে প্রতীয়মান হয়; অন্যদিকে ৪১.৬৭% জেলে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করেছে (১ম থেকে ৫ম শ্রেনী পর্যন্ত) এবং অবশিষ্ট ৫% জেলেরা মাধ্যমিকের গন্ডি (৬ষ্ঠ থেকে ১০ম শ্রেণী) পর্যন্ত পৌঁছেছে।

জরিপ পরিচালনাকালীন সময়ে জেলেদের সাথে আলোচনা করে দেখা গেছে তারা তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতাকে আরও উপরের দিকে নিয়ে যেতে আগ্রহী। তারা শিক্ষিত হতে চায় যেন অন্যরা তাদের অশিক্ষার সুযোগ নিয়ে তাদেরকে প্রতারিত করতে না পারে। মন্দা মৌশুমে যখন জেলেদের কাজ কম থাকে কিংবা একদমই থাকে না তখন অধিকাংশ পরিবার তাদের স্কুল পড়–য়া বাচ্চাদের পড়াশোনার খরচ চালাতে পারে না। আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় পরিলক্ষিত হয়েছে যা হল, এইসব জেলে পাড়ার কাছাকাছি খুব কম সংখ্যক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে।

জেলেদের শিক্ষাগত যোগ্যতার বাইরে শিশুদের শিক্ষাগত অবস্থান প্রমাণ করে যে, অধিকাংশ শিশুই অতি দরিদ্রতার কারণে প্রাথমিক শিক্ষা পর্যন্ত সমাপ্ত করতে পারে না। এর ফলে বাবা-মায়েরা তাদের ছেলে সন্তানদের নিজেদের সাথে নদীতে মাছ ধরার কাজে নিযুক্ত করে। অধিকিন্তু, কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায় যখন কোন পরিবারে কম সংখ্যক উপার্জনকারী সদস্য থাকে কিংবা পরিবারের মৌলিক চাহিদা মেটানোর জন্য অধিক আয়ের প্রয়োজন পড়ে তখন অনেক পরিবারই তাদের ছেলে সন্তানদের অন্য নৌকায় মাছ ধরার জন্য পাঠায়। অন্যদিকে, শিক্ষার সাথে আপোষ এবং অনেক ঝুঁকি থাকার পরেও বাল্যবিবাহ জেলে পারার মেয়েদের ক্ষেত্রে খুবই প্রচলিত একটি ব্যবস্থা। যদিও কোন পরিবারের কোন সন্তান স্কুলের গন্ডি পেরোতে পারে তাদের পিতা-মাতারা সেই সন্তানদের কলেজে ভর্তি করাতে সমর্থ হন না। এর ফলে এসব ছেলেরা হয় মাছ ধরার কাজে নিয়োজিত হয় কিংবা গ্রাম ছেড়ে শহরে এসে তৈরী পোষাক কারখানা কিংবা অন্যান্য ক্ষেত্রে কাজ করে অর্থ আয় করার চেষ্টা চালায়। এর ফলে, শিক্ষা গ্রহণের তীব্র ইচ্ছা থাক সত্বেও শিশুরা শিক্ষা হতে বঞ্চিত হয়।

ঘ) জেলেদের স্বাস্থ্য সুবিধা সমূহ
কোন পরিবার কিংবা সমাজে জীবিকার মান কিংবা অবস্থান নির্ধারণে স্বাস্থ্য পরিস্থিতি গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রতিফলন। জেলেরা যে স্বাস্থ্য সুবিধাসমূহ ভোগ করে তা মোটেও সন্তোষজনক নয়। সাধারণত জেলেরা অদক্ষ, অপেশাদার গ্রাম্য ডাক্তারদের থেকে তাদের প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ করে থাকে। দেখা গেছে প্রায় ৬০% পরিবার অদক্ষ গ্রাম্য ডাক্তার/ ঔষধের দোকানের উপরে নির্ভরশীল যাদের আসলে নিরাপদ চিকিৎসাশাস্ত্র স¤পর্কে কোন ধারণা নেই, যদিও ৩০% পরিবার জটিল কোন সমস্যার কারণে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যায় এবং বাকি ১০% কবিরাজি চিকিৎসার উপরে নির্ভরশীল। একটি ভাল লক্ষণ হল এই যে, বেশিরভাগ পরিবারই তাদের সন্তানদের ক্যা¤েপইন চলাকালীন সময়ে পোলিও টিকা দেবার জন্য নিকটস্থ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যায়।

যাহোক, এক সাধারণ অনুসন্ধানে দেখা গেছে জেলে পাড়ার অবস্থানগত কারণে জেলে পরিবারগুলোর উপজেলা স্বাস্থ্যসেবা কমপ্লেক্স হতে সেবা গ্রহণের হারে ব্যাপক তারতম্য হয়। ভোলা জেলার অধিকাংশ জেলে পাড়াই উপজেলা সদর থেকে অনেক দূরে অবস্থিত যা জেলে পাড়া এবং উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সাথে যোগাযোগ স্থাপনের পথে বিরাট এক অন্তরায়। এবং দুর্গমতার কারণে জেলে পাড়াগুলোতে কমিউনিটি ক্লিনিকও নেই যেখান থেকে প্রয়োজনে জেলেরা তাদের স্বাস্থ্যসেবা পেতে পারে।

ঙ) পরিবারের আকার
এই জরিপে প্রাপ্ত পরিবারগুলোর মধ্যে ৫৩.৩৩% পরিবারে ২-৫ জন, ৪০% পরিবারে ৬-৯ জন, এবং কেবলমাত্র ৬.৬৭% পরিবারে ১০ কিংবা ১০ এর অধিক সদস্য ছিল। দেখা গেছে যে, জেলেরা পূর্বের তুলনায় এখন পবিবার পরিকল্পনার ক্ষেত্রে অনেক বেশি সচেতন।

মোঃ জহিরুল ইসলাম

উন্নয়ন কর্মী



আমাদের ফেসবুক পাতা




প্রয়োজনে কল করুন 01740665545

আমাদের ফেসবুক দলে যোগ দিন







Translate »