আজকের ঝলক
পুরান একটা নিউজ বার বার দেখতেছি। তবে এটা যে আবেগী,অবাস্তব তা নিয়ে আমাদের মাথা ব্যাথা নাই। সব কিছুর একটা বাস্তবতা থাকা দরকার,দরকার প্রেক্ষাপটও।
ইদানিং সোস্যাল মিডিয়ার আর্শিবাদে জানতে পারছি যে, বিবাহের মতো একটি পবিত্র সামাজিক বন্ধনে মোহরানা নিয়ে কিছু আবেগী সিদ্ধান্ত। কেউ দেনমোহর নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ, কেউ ১০০১ টাকা মোহরানা ধার্য করে বিবাহ করিয়াছে, কেহ ৫০০০ টাকা মোহরানা দিয়ে বিবাহ করিয়াছে।
এইসব জ্ঞানীরা রেফারেন্স হিসাবে সাহাবিদের বিবাহের ইতিহাস টানছে, কোন সাহাবীর বিবাহে একটা খেজুর মোহরানা ছিলো, কোন সাহাবী একটা লোহার আংটি দিয়ে বিবাহ করেছেন ইত্যাদি। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, এই জামানার এই বিবাহ যোগ্য পাত্র-পাত্রীগণ কি সাহাবী? তারা কি সাহাবিদের মতো যুদ্ধ করতে করতে সর্বশান্ত হয়েছেন? সাহাবীদের মধ্যে যারা সম্পদশালী ছিলেন তারা কি খেজুর,একটা আংটি মোহর দিয়ে বিয়ে করেছিলেন? জিন নুরাইন হযরত ওসমান রাঃ বিবাহের মোহরানা কতো ছিলো? কারো আইডিয়া আছে কি? সেই সময়ের প্রেক্ষাপট আর বর্তমান প্রেক্ষাপট কি এক মনে করতেছেন?
#রাসূল সঃ এর সাথে খাদিজা (রা) এর বিয়েতে খাদিজা রাঃ এর চাচা আমর ইবনে আসাদের প্রস্তাবে দেনমোহর ৫০০ দিরহাম নির্ধারণ করা হয়েছিলো । ১৫০০ বছর আগে ২৫ বছরের একজন যুবক ৫০০ দিরহামে একজন ১৫ বছরের সিনিয়র বিধবা নারীকে বিয়ে করেছিলো। ৫০০ দিরহামের বর্তমান টাকায় কতো আসে?
#আলী রা. এর সাথে ফাতিমা রা. এর বিবাহ হয়েছিলো আলী রা. এর একটি বর্মের বিনিময়ে। সেই বর্মটি বিক্রয় করা হয়েছিলো ৪০০ বা ৪৮০ দিরহাম (রৌপ্য মূদ্রা) মূল্যে। যার বর্তমান বাজার দর প্রায় ২,০০০ রিয়াল=৪০,০০ টাকা। (এক দিরহাম=প্রায় পোনে ৩ গ্রাম রৌপ্য) প্রশ্ন হলো আলী রাঃ কি খুব সম্পদশালী ছিলেন?
১০০১ টাকা বর্তমান বাজারে মোহরানা হয়না, ৫ ওয়াক্ত নামাজও মোহরানা হয় না। এগুলো আবেগী ফর্মূলা যা আধুনিক যুগে এক ঝাঁক শূণ্য মস্তিষ্কের আবিষ্কার বৈ কিছুই না।
#নামাজের সাথে দেনমোহরের সম্পর্ক কি? এ গুলো কোথায় পাইছেন? এটাতো একজন নারীর সম্মান, সম্ভ্রমের বিনিময়ে একজন পুরুষের চুক্তি। নামাজের সব সাওয়াব কি নারী পেয়ে যাবে? কেমন বলদ মার্কা মোহর ধার্য? এই বিয়ে পড়িয়েছে কোন কাজী? তার মাথায় কি ইসলামিক জ্ঞান মোটেও নেই?
কথা বল্লে কারো গায়ে লাগতে পারে, শরিয়াতে মুমিনের সাথে মুমিনের বিয়ে হওয়ার কথা। এমন মাসালাও আছে, স্বামী স্ত্রী দু’জনের একজন যদি বে নামাজী হয় তাহলে তাদের বিবাহ সহীহ নয়, তাদের শারীরিক সম্পর্ক ব্যাভিচার(Fornication)। নামাজ তো মুমিন হওয়ার পূর্ব শর্ত। তাহলে নামাজের সাথে মোহরানা বা সম্পদের চুক্তি কিভাবে হয়? এগুলো অজ্ঞতা, আঁতলামী নয় কি? যে হাশরের মাঠে একটা নেকীর জন্য মানুষ জান্নাতে যেতে পারবে না, সেখানে একজন নারীকে তার সারাজীবনের পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের সাওয়াব দিয়ে দিবে! ফরজ ইবাদতের সাওয়াব কি আদৌ অন্য কাউকে দেয়ার রেফারেন্স বা নজীর কোন সাহাবাদের জীবনে আছে ?
আবার একদল পাত্র-পাত্রী,প্রেমিক জুঁটি বের হইছে,তাদের ভাষ্য ” যে বিয়ে টিকবে সেটা ১ টাকার মোহরানার বিয়েতেও টিকবে আর যেটা টিকবে না সেটা কোটি টাকা মোহরানায় টিকবে না। কিছুটা মানলাম। কেন আপনারা ১ টাকা, বা ১ কোটি মোহরানা ধার্য করতে যাবেন কেন? ইসলাম মোহরানা ধার্যের স্বাধীনতা দিয়েছে, তাই বলে আবেগী সিদ্ধান্ত! ধর্মীয় বিধান নিয়ে মশকরা করবেন?
মোহরানা পাত্রের সামার্থের মধ্যে একটা রিজনেবল এমাউন্ট হওয়া উচিৎ। চৌদ্দ গুষ্টি খাওয়াইতে যাইয়া মোহরানা পরিশোধ না করতে পারাটা একটা লেইম এক্সকিউজ।
মোহরানা বর্তমান বাজারে নূন্যতম ৫০ হাজার আর সর্বোচ্চটা পাত্রের সামার্থ অনুযায়ী হওয়া উচিৎ। বা সরকার একটা নূন্যতম এমাউন্ট নির্ধারণ করা উচিত যার নিচে করা যাবে না। বা রাসূল সঃ আর খাদিজা রাঃ দেনমোহর টাকায় রুপান্তর করেও ধরা যায়(ব্যাক্তিগত মতামত) নূন্যতম এমাউন্ট দিতে অক্ষম পুরুষরা বিয়ে না করে রোজা রাখুক যা শরিয়াতের নির্দেশ।
আমি যখন এলএলবি পড়তাম, তখন মুসলিম ল পড়তে গিয়ে মোহরানার ব্যাপারে কিছু রেফারেন্স বইতে দেখেছিলাম যে, একজন নারীর মোহরানা নির্ধারণ হয় তার ফ্যামিলি স্ট্যাটাস এর উপর। ফ্যামিলি স্ট্যাটাস বলতে তার পারিবারিক, সামাজিক,বংশীয় মর্যাদা বুঝায়। রেফারেন্স হিসাবে বলেছেন মেয়ের ফুফুদের বিবাহের মোহরানার গড় হবে বিবাহ যোগ্য পাত্রীর মোহরানা। যেমন ধরুণ, পাত্রীর তিন ফুফুর মোহরানা ছিলো যথাক্রমে; ৮০০০০,১২০০০০,১০০০০০,মোট ৩০০০০০ টাকা। তাহলে ঐ ফ্যামিলির বিবাহ যোগ্য কন্যার মোহরানা হবে ৩০০০০০÷৩= ১০০০০০ টাকা। পাত্রের যদি এই সামার্থ বা তার বেশি থাকে তাহলে এই বংশের কন্যাকে বিবাহ করিবে। আর এজন্যই বলা হয় মোহরানা নির্ধারিত হয় পাত্রের সামার্থ ও কন্যার মর্যাদার উপর ভিত্তি করে। এখন পাত্রে ১ লাখ টাকা মেহরানা দেয়ার সামার্থ আছে আর তাকে যদি জোর জবরদস্তি বা নিজেকে বড়োলোক প্রমাণ করতে ১০,০০০০০ টাকা কাবিনে লেখা হয় (চট্টগ্রামবাসীর মতো) তাহলে এটা জুলুম,ইসলামের নিয়ম উপেক্ষা করা বৈ কিছুই না। আর এই টাকা যদি পরিশোধ করা না হয় তাহলে আবারও ফরজ বিধান নিয়ে মসকারা হলো। আবার ঐ একই ব্যাক্তি যার ১০০০০০ টাকা মোহরানা দেয়ার সামার্থ আছে কিন্তু আধুনিক মডারেট প্রেমিক বিয়ের আগেই ১০০১ টাকা ধার্য করে বিয়ে করলো তারাও ধর্মীয় ফরজ বিধানকে বৃদ্ধাঙুলী দেখাইলো।
তবে উভয় পক্ষের সম্মতির ভিত্তিতে সামর্থ অনুযায়ী মোহর কম ও বেশী করা জায়েয রয়েছে। আর সেটা যেন আবেগ আশ্রিত না হয়।
ইসলাম মোহরানার পরিমাণ নির্ধারণ করে দেয় নি। কিন্ত মনে রাখতে হবে, যে পরিমাণ মোহর নির্ধারণ করা হবে তা স্বামীর জন্য স্ত্রীকে দেয়া ফরজ।
কিন্তু স্ত্রী যদি স্বেচ্ছায় সেখান থেকে কিছু অংশ তার স্বামীকে ফেরত দেয় বা মাফ করে দেয় তাহালে এটা তার ইচ্ছা ও স্বাধীনতা, জোর করা যাবে না। পুরোপুরি মাফ করে দেওয়ার কোন নজীর কোন সাহাবীদের জীবনে নাই।
” আমিও তোমার আর আমার সহায় সম্পত্তিও তোমার, বা তোমার পাওনা মোহরানা দিয়ে আমাকে কিনে নাও, মাফ করে দাও এই গরীব স্বামীকে, এবার ঘোমটা খুলো প্রিয় কাহা” এরকমটাও সমীচীন না। বাসর রাতে এটাও এক ধরণের বিব্রতকর ও ভদ্রভাষায় জবরদস্তি একজন নারীর সাথে।
মাসে ২০০০০ টাকা আয় করা যুবকের ৫ লাখ টাকা মোহরানা হয় না, তাহলে সে কোন দিনও পরিশোধ করতে পারবে না। আশ্চার্য হবেন, অনেক শিক্ষিত যুবক জানেই না মোহরানা পরিশোধ করতে হয়,এটা নিছক একটা বিধান তাই কাবিনে লিখতে হয়, এটুকু বৈ কিছুই মনে করে না।
পরিশোধের উপায় একটা আছে, যদি ২ লাখ মোহরানা হয়,কনেকে শপিংয়ে জন্য দেয়া টাকা(শপিং খরচ) + গহনার দাম বাদ দিয়ে যা থাকে তার সব টুকু দিতে না পারলেও নূন্যতম ৫/১০/২০ হাজার ক্যাশ দিয়ে বাকী টাকা প্রতি মাসে মাসে কিস্তিতে পরিশোধ করলেও করতে হবে। সেক্ষেত্রে স্ত্রীকে চেক দেয়া যেতে পারে, মাসের তারিখ উল্লেখ করে Dated Cheque।(যদি ভালো স্বামী, ভালোবাসা থাকে তাহলে সবই সম্ভব) ক্যাশ টাকা না থাকলে টাকার বিনিময়ে নিজের কোন সম্পত্তি (হউক জমি,ব্যাবসা,দোকান স্ত্রীকে জীবদ্দশায় লিখে দিলেও হয় বা সন্তানদের কাছে ওছিয়াত করে গেলেও হয়(স্ত্রীকে স্পর্শ করার আগেই দিয়ে দেয়া উত্তম)।
আইনের ভাষ্য মতে, একজন পুরুষ স্ত্রীর প্রাপ্য মোহরানা পরিশোধ না করে মারা গেলে, স্ত্রী স্বামীর সম্পত্তিতে ইঞ্জেকশন জারি করে, সম্পত্তি দখল করে মোহরানা আদায় করার অধিকার রাখে,এবং স্বামীর সম্পত্তিতে স্ত্রীর প্রাপ্য অংশও পাইবে। সন্তানদের মাঝে সম্পত্তি ভাগাভাগির পূর্বে মোহরানা, আর স্ত্রী ২ আনা সম্পত্তি আলাদা রেখে ভাগবাটোয়ারা হওয়ার নিয়ম। তবে মারা যাওয়ার আগে ডিভোর্স হলে শুধু মোহরানা দাবী করা যায়।
আর যদি ফরজ বিধান মোহরানা পরিশোধ করা থেকে স্ত্রীকে স্বামী বা তার উত্তারাধিকারীগণ বঞ্চিত করে। এ ক্ষেত্রে স্ত্রী নয় স্বামীকে হাশরের মাঠে জেনাকারদের কাতারে দাঁড়াতে হইবে। তবে অনেক মুরব্বিরা মরার আগে পরিশোধ করে। যেমন, আমার এক কাকা চাচিকে একটুকরো জমি দিয়ে গেছেন। আরেক চাচা তার স্ত্রীকে একটা সুপারি বাগান গিফট করে গেছেন। অনেক মুরব্বি এ কাজ করে যান। ভালো লাগে এনাদের এরকম বুদ্ধিমত্তা দেখে
দেনমোহর নিয়ে দেশে বিভিন্ন অঞ্চলে কিছু কুসংস্কার রয়েছে। আর সেটা হলো পাত্রের সামার্থের চেয়েও বেশি মোহরানা ধার্য করা। এটা দিয়ে প্রমাণ করতে চায় পাত্রী অনেক প্রেস্টিজিয়াস ফ্যামিলির, আবার অনেক পাত্র পক্ষও অনেক বেশি ধার্য করে এটা বুঝাতে চায় তারা বংশীয়, ধনাট্য পরিবারের। কিন্তু আদায়ের বেলায় ঠনঠন। এ প্রথার প্রভাব বেশি দেখা যায় চিটাগং অঞ্চলে। কিন্তু দায়ভার হাশরের মাঠে পাত্রকে বহন করতে হবেই। এমনও দেখা যায়, পাত্রের বিয়েতে মোহর নির্ধারণ নিয়ে পাত্রকে কথা বলতে দেয় না। সব ভগ্নিপতিরা আর মামুরা নির্ধারণ করে। পরিশোধ কি মামু ভগ্নিপতি করবে? তারা কেন পাত্রের ঘাঁড়ে বোঝা চাপিয়ে দেয়?
হ্যাঁ তুলনামূলক আলোচনা করতে গেলে বলতে হয়, জানামতে আমাদের সমাজে ৫ লাখ টাকার উর্ধ্বে কারো দেনমোহর নির্ধারণ করেনি। তাতে পাত্র ক্লাস ওয়ান অফিসার হলেও না। পাত্র পাত্রীর প্রেমে দেওয়ানা হইলেও না। ৯০% বিয়ে ৫০ হাজার থেকে ২ লাখের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। আরও দেখেছি বরযাত্রী সংখ্যা ২০ জন থেকে, ১৫০/২০০ মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। ৫০০/১০০০ বরযাত্রীর বিয়ে বরিশাল ডিভিশনে হাজারেও একটা হয় না। তবে সব জায়গায় নিন্দনীয় কাজ হচ্ছে হচ্ছে, এখনো বেশির ভাগ বিয়েতে বরকে ভাবিরা গোসল করায় আর পাত্রির বিয়ের শপিং পাত্রের ভগ্নী পতিরা করে। এরকম চলতে দেয়া যায় না। আরো সচেতন হওয়া উচিৎ।
বিবাহ একটি পবিত্র ধর্মীও বন্ধন আমার দিন দিন সমাজ সংস্কৃতির চর্চার কারণে অপপ্রয়োগ করছি নাতো ? দেনমোহর ও বিবাহ পদ্ধতি নিয়ে সচেতন হওয়ার সময় এখনই ।