বাংলাদেশে ক্ষুদ্র ঋণ

দেশের অর্থনীতি সচল রাখতে পারে ক্ষুদ্র ঋণ !

Spread the love

দেশের অর্থনীতি সচল রাখতে পারে ক্ষুদ্র ঋণ !

প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের সংক্রমণে বিশ্ব এখন টালমাটাল। ছোঁয়াচে এ ভাইরাস এখন পর্যন্ত কোটি কোটি মানুষের মধ্যে সংক্রমণ ঘটিয়েছে, বর্তমানে বিশ্বে সংক্রমণ ১৮ কোটির ওপরে। এর মধ্যে মৃত্যু ঘটেছে ৩৯ লাখেরও বেশি মানুষের। বাংলাদেশেও এ ভাইরাসের ছোবলে দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে মৃত্যুর মিছিল, আক্রান্তের সংখ্যাও বেড়ে যাচ্ছে বানের জলের মতো।
করোনাভাইরাস যে শুধু মৃত্যু ডেকে আনছে তা-ই নয়, এটি দেশে দেশে অর্থনীতির চাকাকেও আবরুদ্ধ করে দিয়েছে। স্থবির করে দিয়েছে জনজীবন ও উৎপাদনের প্রায় সব প্রক্রিয়া। করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে বিশ্বের সব দেশেই বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ ও ব্যবস্থা গ্রহণ করছে । এর মধ্যে অবরুদ্ধ অবস্থা বা লকডাউন অন্যতম। বাংলাদেশেও এর ব্যাতিক্রম নয় সাধারণ ছুটির সময় অবরুদ্ধ অবস্থা কার্যকর থাকে। সরকারী বেসরকারী অফিস-আদালত থেকে শুরু করে দোকান পাঠ ও সকল ধরনের ব্যাবসা প্রতিষ্ঠান সব বন্ধ থাকে ।এতে দেশের অর্থনীতি মারাত্মক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে লাখ লাখ মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছে।
সাধারণ ছুটির মধ্যে জরুরি সেবা ছাড়া প্রায় সবকিছুই বন্ধ। গত এক বছরের বেশি সময়ে বেকার হয়ে গেছেন কয়েক লাখ শ্রমজীবী মানুষ। রফতানি আয় ও বৈদেশিক রেমিটেন্সের পরিমাণ অনেক কমেছে। দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যবসা-বাণিজ্যও প্রায় বন্ধ। কিছু নিত্যপ্রয়োজনীয় দোকানপাট ও হাট-বাজার ছাড়া কার্যত সব বন্ধ।বাংলাদেশ গত কয়েক বছর ধরেই প্রবৃদ্ধির হার ৮ শতাংশ এর বেশি করতে সক্ষম হয়েছে। আশা করা হয়েছিল এ ধারা অব্যাহত থাকবে, কিন্তু করোনার কারণে এ হার অনেক কমে যাচ্ছে। করোনার কারণে বাংলাদেশের জিডিপির একটা বড় অংশ ক্ষতি হতে পারে।
এছাড়া অভ্যন্তরীণ উৎপাদন খাতের পণ্যের চাহিদাও কমবে, যা কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে ঝুঁকি তৈরি করবে। এতে নগর দারিদ্র্য বাড়বে, আবার পল্লী এলাকায় দারিদ্রতার হারও বাড়বে।
মন অবস্থায় কোভিড-১৯-এর ঝুঁকি কমানো এবং আর্থিক খাতের ভঙ্গুরতার ঝুঁকি কমাতে প্রথমেই নজর দিতে হবে কৃষি অর্থনীতি এবং গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক কার্যক্রমকে স্বাভাবিক রাখা ও গতিশীলতা বৃদ্ধি করার ওপর। গার্মেন্ট ও বৈদেশিক রেমিটেন্সের পাশাপাশি যে খাতটি দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে, তা হচ্ছে এনজিও ও এমএফআইয়ের ক্ষুদ্রঋণ ব্যবস্থা। দেশব্যাপী প্রায় সহস্রাধিক প্রতিষ্ঠান দারিদ্র্য নিরসনের লক্ষ্যে প্রায় ৪ কোটির বেশি দরিদ্র, হতদরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষকে প্রায় ১ লাখ ৩ হাজার কোটি টাকারও বেশি ক্ষুদ্র ঋণ প্রদান করেছে। এ ক্ষুদ্র ঋণপ্রাপ্ত পরিবারগুলো উৎপাদন সংশ্লিষ্ট কার্যক্রম যেমন হাঁস-মুরগির ফার্ম, ডেইরি ফার্ম, ক্ষুদ্র কুটির শিল্প, সবজি বাগান, মাছ চাষ, দোকান ইত্যাদি ব্যবসায়িক কাজে ব্যবহার করে নিজেরাও যেমন স্বনির্ভরতা অর্জন করেছে, তেমনই দেশজ উৎপাদনেও সহায়কশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
ফলে যেসব পরিবার দরিদ্র ও হতদরিদ্র ছিল তাদের এক বিশাল অংশেরই দারিদ্র্যতা নিরসন হয়েছে। আত্মকর্মসংস্থানের পাশাপাশি কেউ কেউ অন্যদেরও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে। ভিক্ষাবৃত্তি ও মহাজনি ঋণগ্রস্ত হাতে স্বাবলম্বী উদ্যক্তা অথবা কর্মীতে পরিণত হয়েছে। এভাবেই দেশজ উৎপাদন ও দারিদ্র্যের হার কমে যাওয়ায় জাতীয় অর্থনীতিতে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে। বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের কাতার ছেড়ে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে।
স্বাধীনতার পর থেকে বেশকিছু এনজিও মানুষের মদ্ধে বিশেষ করে দরিদ্র ও হতদরিদ্রদের মদ্ধে জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে কার্যক্রম পরিচালনা করত। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, নারীর ক্ষমতায়ন, নারীদের আত্মকর্মসংস্থান ও নারী-পুরুষ বৈষম্য অবসানের আশ্বাস ইত্যাদি বিষয়ই ছিল মুখ্য। স্বাধীনতার শুরুতে এনজিওগুলো ক্ষুদ্র ঋণের সূচনা করে। এতে করে ব্যাংকের ঋণ বঞ্চিত বিপুলসংখ্যক দরিদ্র মানুষ, বিশেষ করে নারীরা বিভিন্ন সংস্থা থেকে জামানত বিহীন ক্ষুদ্র ঋণ নেয়ার সুযোগ পায়।
এ ঋণে তারা হাঁস-মুরগি, গবাদিপশু ও মাছ চাষসহ সবজি উৎপাদন করে নিজেরাই শুধু স্বাবলম্বী হয়নি, দেশের জাতীয় উৎপাদনেও নিজেদের অর্থনৈতিক শক্তিকে যুক্ত করেছে। বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর গ্রাম পর্যায় পর্যন্ত কার্যক্রম না থাকায় দেশের এক বিশাল জনগোষ্ঠী ব্যাংকে সঞ্চয় ও ঋণ থেকে বঞ্চিত। সেক্ষেত্রে ক্ষুদ্রঋণ প্রদানকারী বিভিন্ন সংস্থা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে। এটি বাস্তব সত্য যে, এমএফআই খাতের প্রায় ১.৫০ (দেড়) লাখ কোটি টাকার ক্ষুদ্র ঋণে প্রায় ৪ কোটির বেশি মানুষ ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেদের অবস্থানকে সুদৃঢ় করছে। তারা শুধু আর্থিকভাবেই দারিদ্রতা দূর করেনি, তারা এখন সামাজিক সচেতনতার বেষ্টনীতেও অবস্থান করছে। তারা পরিবারের স্বাস্থ্য, সন্তানের শিক্ষা, নিরাপদ পানি ও শৌচাগার ব্যবহারে সচেতন হয়েছে। নিজেরা সামাজিকভাবে মর্যাদার অধিকারী হয়েছে। সর্বোপরি আর্থিক সচ্ছলতা তাদের ‘মানুষ’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ এনে দিয়েছে এবং সবই সম্ভব হয়েছে ক্ষুদ্র ঋণ সঠিকভাবে ব্যবহারের মাধ্যমে।
এভাবেই বিশ্বকে অবাক করে দিয়ে বাংলাদেশ ক্রমাগত সামনের দিকে এগোচ্ছিল। বাংলাদেশের জিডিপির মোট দেশীয় উৎপাদন হার ক’বছর ধরে ৭ থেকে প্রায় ৮ শতাংশ হচ্ছিল। কিন্তু করোনার আঘাতে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা লণ্ডভণ্ড হয়ে পড়ায় এ বছর এবং পরবর্তী কয়েক বছর এ ধকল সামলাতে হবে। এতে প্রবৃদ্ধির হার ৪ শতাংশে নেমে আসার আশঙ্কা করছেন দেশের অর্থনীতিবিধরা সেক্ষেত্রে এ ধস ঠেকাতে সরকারকে সুচিন্তিত পদক্ষেপ নিতে হবে।
শিল্পায়নের ফলে কৃষিনির্ভরতা অনেক কমলেও দেশের বার্ষিক জিডিপিতে এখনও কৃষি খাতের অবদান প্রায় ১৩ দশমিক ৫০ শতাংশ।
কৃষি খাতে দেশের প্রায় ৪৫-৫০ শতাংশ জনগণ সম্পৃক্ত। তবে এ কৃষকের আর্থিক অবস্থা মোটেই ভালো নয়। প্রয়োজনীয় সার-বীজ-কীটনাশক ব্যবহার না করতে পারায় ফসল উৎপাদনের পরিমাণ উৎপাদন পর্যায়ের চেয়ে ২৫ শতাংশ কম হয়। অনেক কৃষককেই এজন্য মহাজনের কাছ থেকে টাকা ঋণ নিয়ে উৎপাদিত পণ্য বন্ধক দিতে বাধ্য হতে হতো। এ কৃষক শ্রেণিকে ব্যাংক ও এমএফআই খাত ঋণ সহায়তা প্রদান করায় এ অবস্থা থেকে তাদের বেশ উত্তরণ ঘটেছে এবং দেশজ উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে। নিকট অতীতেও দেশে দারিদ্র্যের হার ছিল ৪০ শতাংশের ওপরে। বর্তমানে এ হার নেমে এসেছে প্রায় ২০ শতাংশে।
কিন্তু করোনার আঘাতে দরিদ্র ও হতদরিদ্র জনগোষ্ঠী ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় দারিদ্র্যের হার আবারও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
জাতীয় যে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ মুহূর্তে দেশের অন্যান্য আর্থিক খাতের মতো এমএফআই ও এনজিও সেক্টরও দুর্যোগ মোকাবেলায় অর্থসহ নানা সাহায্য-সহযোগিতা প্রদান করে।
একথা নিশ্চিত করে বলা যায়, এমএফআই ও এনজিও সেক্টর জাতীয় উন্নয়নের একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ। মানবদেহের প্রতিটি অঙ্গই যেমন শরীরের জন্য জরুরি, তেমনি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, সামাজিক শৃঙ্খলা, বিকাশ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য সচেতনতা ও খাদ্য নিরাপত্তার ক্ষেত্রেও এনজিও খাতের গুরুত্বও অপরিসীম।
যেহেতু দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের গুরুত্বপূর্ণ সেক্টর এমএফআই ও এনজিও সেক্টর ক্ষতিগ্রস্ত এবং দারিদ্রতা নিরসনের জন্য দরিদ্র ও হতদরিদ্র মানুষের মাঝে ক্ষুদ্র ঋণ প্রদান করে থাকে তাই এ সেক্টর সুরক্ষা পেলে দেশের অর্থনীতি আরো বেশি গতিশীল হবে এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠী ক্রমান্বয়ে পরিণত হবে অর্থনৈতিক শক্তিতে এবং সমস্যা কাটিয়ে বাংলাদেশ পাবে উন্নত দেশের মর্যাদা।
লিখেঠেন মোঃ মাহফিদুল আলম
উপ পরিচালক, সিও
আরো পড়ুন

এনজিও কর্মীদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ

দেশের উন্নয়নে এনজিওদের অবদান

ভিডিও দেখুন

https://www.youtube.com/watch?v=gJtk-2wGsCU



আমাদের ফেসবুক পাতা




প্রয়োজনে কল করুন 01740665545

আমাদের ফেসবুক দলে যোগ দিন







Translate »