দেখা থেকেই শেখা; প্রত্যাশা নেই বিনিময়ের

Spread the love

আজকের ঝলক । মুজিবুল হক মুনীর ।

দেখা থেকেই শেখা! কেউ প্রতিশ্রুতি দিলেই তাতে বিশ্বাস নেই, সেটা পূরণ না করা পর্যন্ত! প্রত্যাশা নেই বিনিময়ের!

 

১. কিছুদিন আগেই বার্ষিক পরীক্ষার ফল দিয়েছে, ক্লাস টুতে আমার রোল নাম্বার এক। এমন সময় বড় মামা আমাদের বাড়িতে বেড়াতে আসবেন শুনে দৌড়ে মাইল খানেক দূরের গুজাদিয়া বাজারে গেলাম এগিয়ে আনতে! ভাল রেজাল্ট করায় শিশু মনে বিশেষ স্নেহ পাওয়ার আশা তো ছিলই। ক্লাস টুতে আমার রোল এক শুনে তাচ্ছিল্য করে মামা বললেন, ক্লাস ত্রিতে তোর রোল হবে ১৬! রাগে গা জ্বলে গিয়েছিলো। এই মামার সঙ্গে আমার সম্পর্ক আসলে ওখানেই শেষ। মামা সেদিন বাড়ি থেকে বিদায় নেওয়ার সময় জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা যদি ক্লাস থ্রিতে রোল নাম্বার ১৬ না হয়ে ১ই থাকে? তিনি বললেন, একটা সাইকেল কিনে দেব। আমি জানতাম সেটা ডাহা মিথ্যা! ক্লাস থ্রির বার্ষিক পরীক্ষার ফল জানার কয়েকদিন পর সেই মামার সঙ্গে দেখা হওয়ার পর আমার প্রথম কথাটাই ছিলো- আমার রোল নাম্বার এক, সাইকেল লাগবে না!
২. আমি তখন ক্লাস সেভেনে। মেঝো মামা বললো- ক্লাস এইটে বৃত্তি পেলে তোমাকে একটা মোটর সাইকেল কিনে দেব! হাসতে হাসতে বললাম, কেন বল এসব কথা? সাইকেলের কথা বললেও না হয় মানা যেতো! মামা সেই কথাটা বলেছিলো একদিন আগেই বিয়ে করা নববধূটির সামনে। সেই নতুন মামীকে একটা স্বরচিত ছড়া শুনালে তিনি কৃত্রিম বাহবা দিয়ে বলেছিলেন, আমার ছড়ার বই বের করে দিবেন তিনি! আমি হাসতে হাসতে শেষ। তিনি হাসির কারণ জানতে চাইলে কিছু বলিনি। এই লেখা মামা-মামী দুজনেরই চোখে পড়ার কথা, চোখে পড়লে তারা জানবে যে, আমি হাসছিলাম কারণ দুটি প্রতিশ্রুতির কোনটাই আমি বিশ্বাস করিনি! মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে একজন শিশুকে খুশি করতে তাদের অভিনয়টা ছিলো খুবই দুর্বল ! জীবনের এই পর্যন্ত এসেও আমার ধারণাটা সত্য প্রমাণিত।
৩. তখন সবেমাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি। হঠাৎ মেঝো মামা জরুরি খবর দিলেন। বাসায় গেলে তিনি আমার অনার্সের পুরো চারবছরের আনুমানিক খরচ জানতে চাইলেন। বললাম। তিনি বেশ একটা ভাব নিয়ে বললেন, তোমার পুরো চার বছরের খরচ আমি একবারে দিয়ে দিব! ‘আচ্ছা’- বলেই বিদায় নিয়েছিলাম। একটা টাকাও পাইনি। তিন মামা আর আম্মার নামে ঢাকায় একটা দোকান আছে, সেখান থেকে মাসে সামান্য একটা টাকা পেতাম আমার খরচ চালানোর জন্য। মামা তো কোনও টাকা দেয়ইনি, উল্টো বন্ধ করে দিলো দোকান থেকে পাওয়া সে টাকাটাও, অথচ আম্মাও সেই দোকানের একজন মালিক! নিজের খরচ অবশ্য বেশ ভালোভাবেই চালাতে পেরেছি দৈনিক আজকের কাগজ আর বিভিন্ন প্রকাশনার প্রুফ রিডারের চাকরি করে। এজন্য কেউ কিছু দিতে চাইলে, কিছু নিয়েও যায় কিনা সে ভয়ে থাকি! হাতে পাওয়ার পর খুশি হই, কৃতজ্ঞ থাকি।
৪. আব্বা ছিলো অংকের ‘মাস্টার’। প্রচুর ছাত্র তাঁর কাছে প্রাইভেট পড়লেও আব্বার কাছে ছাত্রদের কোনও তালিকা থাকতো না। এর ফলে কে কখন প্রাইভেটের টাকা দিচ্ছে, কে দিচ্ছে না এর কোনও হিসাব আব্বার কাছে ছিলো না কখনোই। কেউ কেউ মাঝেমধ্যে ২০ টাকা, ৩০ টাকা দিতো। অনেকে কোনও টাকা পয়সা দিতো না। কাউকে কাউকে তো উল্টো বই খাতা কিনে দিতে হতো। বিনামূল্যে প্রাইভেট পড়িয়ে নিজের পকেট থেকে অনেক ছাত্রকেই আব্বা পড়াশুনার কিছু খরচ দিয়েছে। একারণে দিনের পর দিন অনেক ছাত্রকে প্রাইভেট পড়ালেও অন্য অংক মাস্টারের মতো আমাদের পরিবারে সচ্ছলতা আসেনি কখনো।
করিমগঞ্জের নাহার স্টুডিও থেকে একটু সামনেই ছিলো একটি সেলুন। এই সেলুন মালিকের দুই ছেলেকে আব্বা পড়াতো। কখনোই এই দুই ভাই কোনও টাকা পয়সা দেয়নি। বিনিময়ে আব্বা কী পেয়েছে? আমি আর বড় ভাই একদিন চুল কাটাতে গেলাম সেই সেলুনে। মালিক আমাদের চিনতেন না। একটু পরে আব্বা এসে টাকা দিতে চাইলেও মালিক টাকাটা নিলেন না, কিন্তু আমাদের দুজনের প্রতিই দুই কর্মচারীর ব্যবহার পুরো বদলে গেলো। দুটো চুল কাটার টাকা না পাওয়ায় যেভাবে, আকারে ইঙ্গিতে যে ভাষায় আফসোসগুলো তারা করলেন, সেটা টের পেয়ে সেই ৯-১০ বছরের শিশু মনেও ভীষণ-তীব্র অপমানবোধ হয়েছে। টাকাটা না নিয়ে এভাবে আফসোস করাটার মানে বুঝি নি! তাছাড়া মাসের মাসের পর আব্বা ফ্রি প্রাইভেটই বা কেন পড়াচ্ছেন সেটাও বুঝে উঠতে পারিনি। সেদিনের সেই অপমানের কথা এখনো সেলুনে গেলে প্রায়ই মনে হয়, পুরো দৃশ্যটা এখনো স্মৃতিতে একেবারে ঝলমলে! এ থেকে নিয়েছি বড় শিক্ষাও। কারও কোনও উপকার করলে, কারো জন্য কিছু করলে বিনিময়ে অপমান-দু:খ পাওয়ার জন্য নিশ্চিতভাবেই তৈরি থাকি!
(লকডাউনের এই সময়ে অফিসের জন্য প্রচুর কাজ, পড়াশুনা আর সিনেমাতেই নিজেকে ব্যস্ত রাখছি। এরপরেও চিন্তার, স্মৃতি
রোমন্থনের অনেক সময় পেয়ে যাচ্ছি। কয়েকদিন ধরে এই কথাগুলো খুব মনে পড়ছিলো)



আমাদের ফেসবুক পাতা




প্রয়োজনে কল করুন 01740665545

আমাদের ফেসবুক দলে যোগ দিন







Translate »