পূজার মধ্য দিয়ে ঐক্যের পাঠ

Spread the love

আমরা জানি, ‘ধর্ম’ শব্দটি একাধিক অর্থে ব্যব’হৃত হয়। এক অর্থে ধর্ম বোঝায় : যা ধারণ করা হয়। ধৃ+মন্=ধর্ম। জীবের চরিত্র, আচার-আচরণকে একক’থায় তার ধর্ম বলা হয়। যেমন—মানুষের ধর্ম মনুষ্যত্ব, পশুর ধর্ম পশুত্ব। জড়বস্তুর বৈশিষ্ট্যকেও ধর্ম বলা হয়। যেমন অগ্নির ধর্ম দহন করা। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের স্রষ্টা, সর্বশক্তি’মান, সর্বকারণের কারণ অনাদি-অনন্ত বৃহেক ব্রহ্ম বলা হয়। এই ব্রহ্মের বোধকে বলা হয় ধর্ম। এই বৃ’হৎ ও সর্বশক্তিমানের কাছে প্রার্থ’না করলে তিনি মনোবাঞ্ছা পূরণ করেন। তাই তাঁর স্তুতি করা এবং নানা প’দ্ধতিতে তাঁর উপাসনা ‘করা হয়।

এই উপা’সনার পদ্ধতিগত পার্থক্যের জন্য মনু’ষ্যকুলে বিবিধ ধর্মসম্প্রদায়ের সৃষ্টি হয়েছে। আবার একই ধর্মসম্প্রদায়ের মধ্যে মত ও পথের পা’র্থক্যের কারণে উপসম্প্র’দায়গুলোর’ সৃষ্টি হয়েছে।

সনাতন ধর্মের (হিন্দু ধর্ম) ক্ষে’ত্রেও এ কথা প্রযোজ্য। সনাতন ধর্মে’র মূল ধর্মগ্রন্থ হিসেবে ‘বেদ’কে স্বীকার করা হলেও একই বেদের বিভিন্ন শাখার সৃষ্টি হয়েছে। পরবর্তীকালে বৈদি’ক যজ্ঞের স্থলে’ ঘটে-পটে প্রতিমায় বিভিন্ন দেব-দেবীর পূজা করার রীতি ও প্রথার উদ্ভব ঘটেছে। তবে একেশ্বরবাদের চিন্তাটি কখ’নো পরিত্যক্ত হয়নি। দেবতারা ঈ’শ্বর নন। ঈশ্বরের বিভিন্ন শক্তি ও গুণকেই দেবতারূপে প্রতী’কায়িত করা হয়েছে।

সমাজ ও ব্যক্তি ‘জীব’নের শৃঙ্খলা বিধানের জন্য গৃহীত বিচিত্র বি’-বিধানের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে যে শাস্ত্রের সৃষ্টি করা হয়েছে, তাকেও বলা হয়েছে ধর্মশাস্ত্র। এখানে ‘ধ’র্ম’ শব্দটির মানে বিধি-বিধা’ন। এসব বিধি-বিধান অনুসারে উপাসনা ও জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত বিভিন্ন ধর্মানুষ্ঠান করার প্রথা প্রচ’লিত হয়েছে। সেসব বিধি-বিধান, রীতি-নী’তি ও আচার-অনুষ্ঠানের মধ্যেও পার্থক্য রয়েছে।

সুতরাং কতকগুলো বিশ্বাস, কতকগুলো আ’চার, কতকগুলো অনুষ্ঠান—এই তি’নের মিলই প্রচলিত অর্থে ধর্ম নামে পরিচিতি লাভ করেছে।

ছান্দোগ্য উপনিষদে ধর্মক’র্মকে তিনটি ভাগে স্থাপন করা হ’য়েছে : যজ্ঞ, অধ্যয়ন, দান; ত’পস্যা; আচার্যগৃহে ব্রহ্মচর্য পালন।

যোগশাস্ত্রে বলা হয়েছে যে ধ’র্ম চারপদ। অর্থাৎ ধর্ম চারটি প্রধা’ন বৈশিষ্ট্যের ওপর ভর করে দাঁ’ড়িয়ে আছে। সেগুলো হলো : তপস্যা, শৌচ, দয়া ও সত্য। ত’পস্যাই হচ্ছে সাধনা। এই তপ’স্যা আবার তিন প্রকার।

১. শারীরিক তপস্যা : শা’রীরিক তপস্যা হচ্ছে—শীত, তাপ, ক্ষুধা, পিপা’সা, দুঃখ সহ্য করার ক্ষমতা এবং সর’লতা, ব্রহ্মচর্য, অহিংসা ইত্যাদি।

২. বাচিক তপস্যা : বাচি’ক তপস্যা হলো সত্য, প্রিয় ও হিতকর বা’ক্য ও শাস্ত্রাভ্যা’স।

৩. মানসিক তপস্যা : মান’সিক তপস্যা হচ্ছে চিত্তের প্রসন্ন’তা, অক্রূরতা, বাক’সংযম, আত্মসংযম, কপ’টতা না করা ইত্যাদি।

বৈদিক যুগের আর্যদের ধর্মীয় প্রধান অনু’ষ্ঠান ছিল যজ্ঞ। অগ্নি প্র’জ্বালন করে কাঙ্ক্ষিত দেবতার প্রতি স্তুতি করা হয় এবং মর্তের প্রত্যক্ষ দেবতা অগ্নি, তাঁর প্র’তি স্তুতি জানানো হয়, তাঁকে উ’ৎসর্গ করা হয় নৈবেদ্য এবং তাঁর কাছে চা’ওয়া হয় পার্থিব সুখ ও স্বর্গ। যেহেতু অগ্নি মর্তের প্রত্য’ক্ষ দেবতা, তাই তাঁর মাধ্যমে ‘ইন্দ্র, সূর্য প্রভৃতি দেবতার কা’ছে স্তুতি জানানো হয়, তাঁদের কা’ছেও পার্থিব সুখ ও স্বর্গ কামনা ‘করা হয়। এটাই ছিল বৈ’দিক যুগের আর্যদের ধর্মানু’ষ্ঠান।

প্রাগার্যদের ছিল পূ’জা। আর্যরা প্রাগার্যদের কাছ থেকেই ‘পূজা’ভিত্তিক উপাসনা পদ্ধতি’ গ্রহণ করে। বৈদি’ক যুগের পর পৌরাণিক যুগে ব্রহ্মের গুণ ও শ’ক্তির প্রতীক বা প্রতিমা নির্মাণ ক’রে প্রত্য’ক্ষভাবে পূজা পদ্ধতি আর্যরা গ্রহণ করে। ঘটে’ আর্য ও প্রাগার্য সভ্যতার মিশ্রণ। আ’র এর মিশ্রণের মধ্য দিয়েই রূ’প পায় সনাতনী সভ্যতা ও সং’স্কৃতি। ধর্মটিকে বলা হয় সনাতন ধর্ম। এই সনাতন ধর্মের প্রচ’লিত নাম হিন্দু ধর্ম।

ধর্মীয় আনুষ্ঠা’নিকতা কখনো কখনো ধর্মে’র মূল উদ্দেশ্যকে ছা’পিয়ে উঠেছে। উদ্দেশ্যের চে’য়ে উপায় ও আনুষ্ঠানিকতাকে বড় করে দেখা হ’য়েছে। ধর্মদর্শন ও ধর্মা’নুষ্ঠানকে ব্যব’হার করা হয়েছে ব্যক্তি বা গোষ্ঠী’স্বার্থে।

আবার ধ’র্ম অনড়, অচল নয়। যুগের পরি’বর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ধর্মচিন্তার ক্ষে’ত্রেও ঘটেছে নানা পরিবর্তন। কিন্তু অনেকেই নতুন যুগের উপযোগী পরিবর্তনকে মেনে নি’তে চান না। পুরনো ধারণাকে আঁক’ড়ে থাকেন।

ধর্মদর্শন থেকে নৈতিকতা বা মূল্য’বোধ অর্জন প্রত্যাশিত। আম’রা তার থেকে দূরে সরে যাই, আ’নুষ্ঠানিকতাই যেন হয়ে ওঠে ধর্ম। তখন নিজ ধর্ম বা নিজ মত’কে কেউ কেউ শ্রেষ্ঠ বলে ভাবে। কে’উ কেউ তো অপরের ধর্ম ও ধ’র্মীয় আনুষ্ঠানিকতার প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণ করে। আর’ সেই মানসিকতা থে’কে জন্ম নেয় সাম্প্রদায়িকতা, সংকী’র্ণতা, গোষ্ঠী বা বর্ণবিদ্বেষ।

যুগে যুগে তাই ধর্মীয় নৈতিকতার প্রবক্তারা রুখে দাঁড়ি’য়েছেন। দিয়েছেন নববিধান। এর মহ’ত্তম দৃষ্টান্ত শ্রীচৈতন্যদেব। তিনি বর্ণভেদকে বিলুপ্ত করে স’ইকে একই শ্রেণিতে নি’য়ে আসার বাণী প্রচার করেছেন। বর্ণভেদের প্র’শ্নে শ্রীচৈতন্যদেব ষোড়শ শতকে যে প্রগতিশীলতা, মানবতা ও বৈপ্ল’বিক চেতনার পরিচয় দিয়ে’ছিলেন, আমরা একুশ শতকে এসে’ও সামাজিকভাবে তার পরিচয় দিতে পারছি না। মা’নুষের জন্য ধ’র্ম, না ধর্মের জন্য মা’নুষ?

ধর্মচিন্তা বা ধ’র্মদর্শন আমাদের যে শিক্ষা দি’চ্ছে, আমরা তাকে আমাদের নৈ’তিকতার অংশে পরিণত করতে অ’নেক ক্ষেত্রেই ব্যর্থ হচ্ছি। শুধু ধর্মানুষ্ঠান ও কৃ’ত্যাদি শাস্ত্রানুসারে অনুষ্ঠিত ক’রে চলেছি।

শুধু আনুষ্ঠানিকতা নয়, ধর্মদ’র্শন ও ধর্মানুষ্ঠান থেকে আমরা নিষ্কাশ’ন করে নেব নৈতিকতার আদর্শ। শ্রীদুর্গা দেবীকে পূজা করার মধ্য দিয়ে আমরা পাঠ নেব ঐক্যের। কারণ দে’বী দুর্গা আবির্ভূত হয়ে’ছিলেন দেবতাদের সম্মিলিত তেজ থেকে। পাঠ নেব অশুভ দলনের। কারণ দেবী দু’র্গা অশুভকে বিনাশ করে শু’ভকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন।

লেখক : ঢাকা বিশ্ব’বিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভা’গের সংখ্যাতিরিক্ত অধ্যা’পক



আমাদের ফেসবুক পাতা




প্রয়োজনে কল করুন 01740665545

আমাদের ফেসবুক দলে যোগ দিন







Translate »