সামাজিক যো’গাযোগ মাধ্যমে নিজেকে ঢাকার ন’বাব পরিবারের বংশধর অর্থাৎ নওয়াব স’লিমুল্লাহর নাতি হিসেবে পরিচয় দিতেন তিনি। তার বাবা নিউ ইয়র্কে থাকেন বলে বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়িয়েছেন। এম’নকি তার বাবা ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিলের চেয়ারম্যান এবং দুবাইতে তাদের গোল্ড কারখানা রয়ে’ছে বলে প্রচার করতেন। এভা’বে তার সম্পর্কে যত খোঁজ নিচ্ছেন তদন্তকারীরা তার সম্পর্কে প্রতিদিনই নতুন নতুন ত’থ্য পাচ্ছেন। সেই সঙ্গে বিভিন্ন স’রকারি-বেসরকারি ও সাধারণ মানুষকে বোকা বানিয়ে তিনি কিভাবে কোটি কোটি টাকা হা’তিয়ে নিয়েছেন আর এই প্রতার’ণার কাজে সে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নাম পরিচয় ব্যবহার করে প্রতারণা করে। এভাবে তদ’ন্তে তার সম্পর্কে আরো অ’নেক চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসছে তদন্তে।
ঢাকার নবাব পরিচয়ে প্র’তারণাকারী সেই আলী হাসান আসকারীকে রিমাণ্ডে নিয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রা’ইম ইউনিটের কর্মকর্তারা জানতে পেরেছেন, ২০০৫ সালে তার বাবা ‘আমান উল্লাহ’ ঢাকার উত্তরায় বসবাসরত অবস্থায় মারা যান। পুরান ঢাকার ইসলামবাগে তাদের কা’পড়ের ব্যবসা ছিল। নিউ ইয়র্কে থাকা, ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিলের পরিচয় এবং দুবাইয়ে ব্যবসার ক’থা বলে তিনি মানুষের আস্থা অর্জন ক’রে প্রতারণা করতেন। এছাড়া নবাব এস্টেটের সম্পত্তি দখলেরও পাঁয়তারা করছিল সে। এ’জন্য সে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের ভূমি অ’ফিসে পাঁচটি ‘মিস কেস’ও করেছিল। তিন দিনের রিমান্ডের জিজ্ঞাসাবাদে এসব ত’থ্যের পাশাপাাশি সে স্বীকার করেছে তার দী’র্ঘ জীবনের অনেক প্রতারণার কথা।
এদিকে প্র’তারণার অভিযোগে হাসান আলী আসকারীর বি’রুদ্ধে আরো দুটি মামলা দায়ের ক’রেছে দুই ভুক্তভোগী। রাজধানীর মিরপুর ও ম’তিঝিল থানায় গত শনিবার এই মামলা দু’টি নথিভুক্ত হয়েছে। পুলিশ কর্মকর্তারা বল’ছেন, এই ভুয়া নবাবের বিরুদ্ধে প্রতিদিনই প্র’তারণার নানান তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। তবে এ’খনও সে তার সঠিক নাম-পরিচয় সম্পর্কে কিছু বলেনি।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জা’না গেছে, আলী হাসান আসকারী ঢাকা’র নবাব এস্টেটের সম্পত্তির মধ্যে শাহ’বাগের একটি অংশের মোতাওয়াল্লী হ’ওয়ার জন্য ভূমি অফিসে দু’টি মিসকেস (৭০৭/২০২০, ৮৯০/২০২০) করেছেন। এছা’ড়া নারায়ণঞ্জেও নবাব এস্টেটের কি’ছু সম্পত্তির মোতাওয়াল্লী হওয়ার জ’ন্য তিনটি মিসকেস (৬৬৬/২০২০, ৬৬৭/২০২০, ৬৬৮/২০২০) ক’রেছেন। বর্তমানে এসব সম্পত্তি ভূমি সং’স্কার বোর্ডের অধীনে কোর্ট অব ওয়া’র্ডসের মাধ্যমে দেখভাল করা হয়। নবাব পরিবারের বং’শধর না হওয়া সত্ত্বেও এসব মিস কে’স করার কারণ জানতে চা’ইলে হাসান আলী আ’সকারী জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন, তিনি মূলত নবাব পরিবারের কে’উ নয়। অনেকেই ভু’য়া বংশধর সেজে নওয়াব এস্টেটে’র বিভিন্ন সম্পত্তির মোতাওয়াল্লী হয়েছেন। তাই তিনিও সেই উ’দ্দেশ্যে এসব কেস করেছেন। ত’বে এগুলোর কোনো কিছুতেই তিনি সফল হতে পারেননি।
নবাব নামে জা’তীয় পরিচয়পত্র : তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে’ জানা গেছে, ২০১৪ সালে ঢাকার নিকুঞ্জ এলা’কার ওয়ার্ড কাউন্সিলের কাছে নিজের নামে নবাব খাজা আলী আহসান আসকারী না’মে একটি জন্ম নিবন্ধন নিয়েছেন তিনি। মূল’ত সেই জন্ম নিবন্ধনের ভিত্তিতে তিনি নবাবের বংশধর হি’সেবে পরিচয় দেওয়া শু’রু করেন। এছাড়া ২০১৫ সালে তিনি ঢাকার আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস থেকে একটি পাসপোর্ট সং’গ্রহ করেন। তার পাসপোর্টের নথিপত্র ঘেঁ’টে সেখানে পুলিশ ভেরিফিকেশনের কোনো নথি পাওয়া যায়নি। এখানেও সে বড় ধর’নের প্রতারণা ক’রেছে। স্থায়ী ঠিকানা হিসে’বে সেখানে উত্তরার মাসকট প্লাজা লেখা রয়েছে। তবে ধারণা করা হচ্ছে, কোনো অসা’ধু চক্রের মাধ্যমে তিনি পু’লিশ ভেরিফিকেশন ছাড়াই পাসপোর্ট হাতে পান। সেই সঙ্গে জন্ম নিবন্ধন ও পাসপোর্ট দিয়ে তিনি ২০১৭ সা’লে আবেদন করে নবা’ব খাজা আলী হাসান আসকারী নামে জাতীয় পরিচয়পত্র সংগ্রহ করেন। তবে জিজ্ঞাসাবাদের শুরুতেই জা’তীয় পরিচয়পত্র না নিয়ে ২০১৭ সালে জা’তীয় পরিচয়পত্র নেওয়ার কারণ জানতে চাইলে আসকারী কো’নো উত্তর দিতে পারেনি। এ কা’রণে ধারণা করা হচ্ছে আগে তা’র অন্য কোনো নাম ছিল। জন্ম নিবন্ধনের সূত্র ধরে সে পরে নতু’ন করে নতুন নামে জাতীয় পরিচ’য়পত্র সংগ্রহ করেছে।
সংসদ নির্বাচনেও প্রতারণা : ওই জাতীয় পরিচ’য়পত্রের সূত্র ধরেই আসকা’রী চলতি বছর ঢাকা-১০ আ’সনের উপ-নির্বাচনে বাংলাদেশ মুসলিম লীগের হয়ে সংসদ সদস্য পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে’ছিলেন আসকারী। জিজ্ঞাসাবাদে তি’নি বলেছেন, ওই নির্বাচনে ভোট পেয়েছিলেন মাত্র ১৫টি। নির্বা’চন কমিশনে জ’মা দেওয়া হলফনামা ও সম্পদ বিবরণীতে বাত্সরিক আয় দেখিয়েছেন ৬ লাখ টাকা। সম্পদবিব’রণীতে নিজেকে ন’বাব খাজা হাসান আসকারী জু’ট মিলস লিমিটেড এবং আঞ্জুমান আসকারী বেওয়ারীশ লাশ দাফ’ন নামে দুটি প্রতিষ্ঠানের চে’য়ারম্যান হিসেবে উল্লেখ করে’ছেন। তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আসকারী জুট মিলস নবাব এস্টে’টের সম্পত্তি। সরকার এই মিল অ’ধিগ্রহণ করেছিল। পরে তা পরিচালনার জন্য বেসরকারিখাতের শিক’দার গ্রুপের কাছে দে’ওয়া হয়েছে। এখন আ’লী হাসান আসকারী সেই জুট মিলসের চেয়ারম্যান হিসেবে দাবি করে আসছেন। এছা’ড়া আঞ্জুমান আসকারী নামে প্র’তিষ্ঠানটিও নামস্বর্বস্ব। হ’লফনামায় নিজেকে মাস্টার্স পাস উল্লেখ করলেও জিজ্ঞাসাবাদে আ’সকারী এস’এসসিও পাশ করেনি বলে জানতে পেরেছে ত’দন্ত সংশ্লিষ্টরা।
সা’বেক আইজিপির নাম ভাঙিয়েও প্র’তারণা : পুলিশ জানি’য়েছে, ২০১৭ সালের শেষের দিকে মা’ওলানা সিরাজী নামে এক ব্যক্তির মাধ্যমে আশকারীর সঙ্গে জামালপুরের মাহমুদুল হাসান নামে এক ব্য’ক্তির পরিচয় হয়েছিল। পুলি’শের সাবেক আইজিপি জাবেদ পাটোয়ারীর সঙ্গে তার সখ্যতা রয়েছে জা’নিয়ে আশকারী তাকে এ’সআই পদে প্রার্থী দিতে বলেছিল। মাহমুদ জামালপুরের এক প্রার্থী যোগার করে বি’শ লাখ টাকার বিনিম’য়ে চাকরি পাইয়ে দেওয়ার জন্য চুক্তি ক’রেছিল। সেই সঙ্গে মাহমুদসহ সাতজনকে সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবে’থ হাসপাতালে চা’করি দেওয়ার কথা বলে ২৩ লা’খ টাকা নেয়। মাহমুদ রিমাণ্ডে জানান, পুলিশের সাবেক আইজিপি জাবে’দ পাটোয়ারী নিজে ঘু’ষ খান না জানিয়ে তার স্ত্রীকে দি’ চাকরি দেওয়ার কথা বলে আসকারী। এজন্য সাবেক আইজিপির স্ত্রীকে স্বর্ণালঙ্কার কি’নে দিতে হবে বলে জা’নায়। তারা আমীন জুয়ে’লার্স থেকে ১০ লাখ টাকার স্বর্ণালঙ্কার ও নগদ ১০ লাখ টা’কা দেন আস’কারীকে। মালিবাগের সি’আইডি কার্যালয়ের সামনে থেকে এসব স্বর্ণালঙ্কার ও টাকা গ্রহণ করেন তিনি। এর বাই’রে সিঙ্গাপুর যাওয়ার জ’ন্য সিরাজীর মাধ্যমে ক’য়েক দফায় ২৩ লাখ টাকা দেন। মাহমুদ জানান, প্রতারিত হয়ে তিনি এখন পালিয়ে বে’ড়াচ্ছেন। যাদের কাছ থেকে টাকা নি’য়ে আসকারীকে দিয়েছিলেন তারা তাকে খুঁজছে। এজন্য তিনি ভয়ে দুই বছর ধরে নি’জের গ্রামের বা’ড়িতেও যেতে পারেন না।
প্রতারণার অ’ভিযোগে আরো দুই মামলা : সি’ঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে না’র্স নিয়োগের নামে ফেনীর ৪০০ ব্যক্তির কাছ থেকে তিন কোটি ৩৪ লা’খ টাকা নিয়েছিলেন প্র’তারক আসকারী। প্রতারিত ব্য’ক্তিদের পক্ষে সালমান নামে এক মাদরাসা শিক্ষকের দায়ের করা মা’মলায় গত বুধবার রাজধানীর বি’ভিন্ন এলাকা থেকে পাঁচ সহযো’গীসহ আসকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়। আ’সকারীর গ্রেপ্তারের খ’বর চাউর হওয়ার পর প্র’তারিতদের অনেকেই ঢাকার কাউ’ন্টার টেরোরিজম ই’উনিটে যোগাযোগ শু’রু করে।
এরই ধারাবাহিকতায় গত বৃহস্পতিবার মান’জুর রহমান নামে এক ব্য’ক্তি মিরপুর থানায় আসকারীর বিরু’দ্ধে ৪৮ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অ’ভিযোগে একটি মামলা দা’য়ের করেছেন। আর গত শ’নিবার (৩১ অক্টোবর) তাজুল ইসলাম নামে আরেক ব্যক্তি মতিঝিল থানায় একটি মা’মলা দায়ের করেছেন। সি’ঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেদ হাসপাতালে চা’করি দেওয়ার নাম করে আসকারী তা’র কাছ থেকে ৪৩ লা’খ টাকা নিয়েছে বলে তিনি মা’মলায় অভিযোগ করেছেন।
সামনে টিভি ক্যা’মেরা ছিল, তাই একটু বানিয়ে ব’লেছি : প্রতারক আ’সকারী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিউ ইয়র্কে গি’য়ে তার বাবা আমানুল্লাহ আসকারীকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার অনুরোধ ক’রেছিলেন বলে না’মসর্বস্ব একটি অনলাইন টিভির কথিত সাক্ষাৎকারে ব’লেছিলেন। ওই সাক্ষাৎকারে প্র’তারক আসকারী বলেন, ‘আমার জন্ম হলো’ মক্কাতে, বড় হয়েছি নিউ ইয়র্কে, সেটেলড আ’মস্টার্ডাম নেদারল্যান্ড। যদিও আমার বিজনেস দুবাইতে। আমি আমার বাবার বিজনেস দেখি, আমার বাবা হলেন- নবাব আমানুলাহ সাহেব, উনি ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউ’ন্সিলের চেয়ারম্যান, ওয়ার্ল্ডে যত গোল্ড সাপ্লাই হয়, সেটা আমাদের ফ্যাক্টরি থেকে হয়। আমাদের ফ্যা’ক্টরি প্রথমে ছিল নিউ ই’য়র্কে। পরবর্তীতে এই ফ্যাক্টরি আমি রাসেলফাইমাতে নিয়ে আসি, দুবাইতে। এখন আমাদে’র গোল্ডগুলো দু’বাইতে রিফাইন হয় এবং পুরা ওয়ার্ল্ডে সাপ্লাই হয়।’
ওই সাক্ষাৎকারে প্রধানমন্ত্রী শে’খ হাসিনাকে নিয়েও মিথ্যাচার করেন আসকারী। তিনি বলেন, ‘আজ থেকে দুই বছর আগে শেখ হাসিনা যখন নিউ ইয়র্কে গিয়েছিলেন আমার বাবার কাছে ব’লেছিলেন, যে ভাই আমি অনেক অসুবিধায় আছি, আপনি বাংলাদেশে আসেন, সুষ্ঠু একটা নির্বাচন দেন, যে নির্বাচনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারে’র প্রধান আপনি হবেন এবং সুন্দর একটা নির্বাচন আপনি উপহার দেন। তখন আব্বা ব’লেছিলেন, ‘না আমার বয়স হয়ে গেছে, আমা’র পক্ষে হয়তো এই মুহূর্তে বাংলাদেশে যাওয়া সম্ভব না, তবে আমার একমাত্র ছেলে ‘আলী হাসান আসকারী ও বাংলাদে’শে যাবে। দেন আমি বাংলাদেশে আসি।’
সঠিক পরিচয় শনাক্তের চেষ্টা : তদন্ত সং’শ্লিষ্টরা আলী হাসান আসকারীর আসল প’রিচয় জানার চেষ্টা করছেন। জিজ্ঞাসাবাদে আলী হাসান আহসান উল্লাহ সড়কে তাদে’র দুই কাঠার ওপর এক’টি বাড়ি ছিল বলে জানিয়েছেন। তবে আহসান উল্লাহ রোডে ওই বাড়ির কোনো খোঁজ পাও’য়া যায়নি। পুলিশ কর্মকর্তারা বল’ছেন, তারা জানতে পেরেছেন, আলী হাসান আসকারী প্রায় এক যুগ আগে চুয়াডাঙ্গার এক না’রীকে বিয়ে করেন।সেই স্ত্রীর আগেও বি’য়ে হয়েছিল। তার দুই সন্তান। ব’ড় সন্তান নিয়েও প্রতারণা করেছেন আসকারী।
কা’উন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যা’শনাল ক্রাইম ইউনিটের অ’তিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম বলেন, আলী হাসান আ’সকারীর প্রতারণার কোনো শেষ নে’ই। প্রতিদিনই তার সম্পর্কে নতুন নতু’ন তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। তার সহযোগীদেরও গ্রেপ্তা’রের চেষ্টা চ’লছে। ‘