গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ

টেকসই মৎস্যসম্পদ বিনির্মাণে নারীর অংশগ্রহণ এবং নারীর আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন আবশ্যক

ডিসেম্বর ২০ ২০২০, ২১:০৪

Spread the love

গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ :

১. ভূমিকা
বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম মৎস্য উৎপাদনকারী দেশে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এখানে প্রায় ৪২.৭৭ লক্ষ মেট্রিক টন মৎস্য উৎপাদন করা হয় যার ৫৬.২৪ শতাংশ জলকৃষি (অয়ঁধপঁষঃঁৎব)। গত দশ বছরে এই খাতে প্রবৃদ্ধির হার ৫.২৬ শতাংশ। মৎস্য চাষ এক্ষেত্রে আরো অগ্রগামী এবং একই সময়কালে এটি ১০ শতাংশের মতো প্রবৃদ্ধির ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছে। আশা করা হয়, এই প্রবৃদ্ধির হার বজায় থাকলে বাংলাদেশ রূপকল্প ২০২১ এর লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ২০২১ সালের মধ্যে ৪৫.৫২ লক্ষ মেট্রিক টন জলকৃষি সম্পদ উৎপাদন করা সম্ভব হবে। উপরন্তু, অভ্যন্তরীণ উন্মুক্ত জলাশয় থেকে মৎস্য আহরণে বাংলাদেশ ৩য় স্থান অর্জন করেছে এবং বৈশ্বিক জলকৃষিতে ৫ম স্থান অর্জন করেছে।
জলকৃষিতে বাংলাদেশে প্রায় ৩০ লক্ষ মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে যার ৬০% ভাগই নারী । গ্রামীন ও উপকূলীয় অঞ্চলে ৩০% নারীই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ক্ষুদ্র পরিসরে মৎস্য জীবিকার সাথে যুক্ত। বাংলাদেশে মৎস্য খাতে মোট কর্মসংস্থানের প্রায় ১০ থেকে ১২ শতাংশ নারী । নারীর অবদানের মূল ক্ষেত্রগুলো হচ্ছে মৎস্য চাষ, চিংড়ি চাষ, মৎস্য প্রক্রিয়াজাতকরণ, জাল ও অন্যান্য উপকরণ তৈরি ইত্যাদি। নারীর সমুদ্রে মৎস্য আহরণে সরাসরি যুক্ত না থাকলেও অভ্যন্তরীন জলমহালগুলোতে পুরুষের পাশাপাশি পরিবারের সদস্য হিসেবে মৎস্য উৎপাদনে সক্রিয়ভাবে যুক্ত।
কিন্তু, মৎস্য খাতে নারীর কাজ এবং সমাজ ও অর্থনীতিতে তার অবদান বিস্ময়করভাবে অনুপস্থিত। এবং তারা পরিবারে ব্যবস্থাপনা ও উন্নয়ন সম্পর্কিত সিদ্ধান্তগ্রহন প্রক্রিয়ায় ব্যাপকভাবে উপেক্ষিত। বাস্তবতা হচ্ছে, বাংলাদেশের জলকৃষি খাতের মতো একটি দ্রুত বর্ধনশীল বাণিজ্যিক কর্মকা-ে নারীরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেও মৎস্য খাতের এই সোনালী উত্থানের সুফল তারা ভোগ করতে পারছেন না। বরং ক্রমে তারা নি¤œ মজুরি, বেশি কর্মঘন্টা, ঝুঁকিপূর্ণ কাজ, পুরুষের দ্বারা নিপীড়নের শিকার হওয়া ইত্যাদি দ্বারা আরো বেশি অবনতির শিকার হয়েছেন, যেহেতু তাদের কাজের স্বীকৃতি নাই । ফলে, এর সাথে যুক্ত বিষয়গুলো অনুধাবন এবং মৎস্য খাতে জেন্ডার সংবেদনশীল কাজ ও নারীর ক্ষমতায়নের বিষয়টি অপরিহার্য হয়ে উঠেছে।
এই স্টাডিতে সামুদ্রিক মৎস্য আহরণ খাতে নারীর অংশগ্রহন এবং তাদের ক্ষমতায়নের পরিস্থিতি জানার চেষ্টা করা হয়েছে। এজন্য এই কাজে বিদ্যমান প্রতিবেদন বিশ্লেষণের (লিটারেচার রিভিউ) পাশাপাশি বাংলাদেশের বৃহত্তর উপকূলীয় অঞ্চলের প্রতিনিধিত্ব স্বরূপ তিনটি উপকূলীয় জেলা থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে।
২. স্টাডির উদ্দেশ্য
এই স্টাডির প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে বাংলাদেশের কক্সবাজার, ভোলা ও বাগেরহাট জেলার তিনটি উপজেলা যথাক্রমে কক্সবাজার সদর, ভোলা সদর ও শরণখোলায় মৎস্য খাতে নারী-জেলের গুরুত্বপূর্ণ অবদান ও তাদের আর্থ-সামাজিক ক্ষমতায়নের চিত্র চিহ্নিত করা। পাশাপাশি, জেন্ডার দৃষ্টিকোণ ও বাংলাদেশের বিদ্যমান নীতির সাপেক্ষে জেলেদের জন্য কী অধিকার রয়েছে তা চিহ্নিত করা এবং তার কতটা তারা ভোগ করে সেটাও তুলে ধরা। এই স্টাডির আরেকটি উদ্দেশ্য হচ্ছে, উপকূলীয় অঞ্চলে মৎস্য ও জলকৃষিতে সম্পদ নিরূপণ ব্যবস্থাপনা অনুধাবন করার চেষ্টা করা যাতে তা কিভাবে নারী ও অন্যান্য প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে প্রভাবান্বিত করছে তা নিরূপণ করা, বিশেষ সম্পদ ব্যবহারের ক্ষেত্রে তাদের প্রবেশাধিকারের বিষয়ে।
জেন্ডার মূলধারাকরনের পরিস্থিতি যাচাই এবং বিভিন্ন জেন্ডার ডাইমেনশনে সমস্যার ধরন এবং বিভিন্ন গ্রুপে তার প্রয়োজন নিরূপণের চেষ্টাও এই স্টাডিতে করা হয়েছে। স্টাডির আরো লক্ষ্য হচ্ছে, এই অঞ্চলে জীবন যাপনের পদ্ধতি, উপকূলীয় সম্পদে নির্ভরশীলতা, সম্পদ ব্যবহার, সম্পদে প্রবেশাধিকার এবং সম্পদ ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি অনুধাবন করা। প্রাপ্ত তথ্য ও উপাত্ত বিশ্লেষণ করে এই স্টাডি থেকে কিছু সুপারিশও উপস্থাপন করা হবে।
৩. স্টাডি প্রতিবেদনের আউটলাইন
এই স্টাডিতে বাংলাদেশের সামুদ্রিক মৎস্য খাতের একটি চিত্র তুলে ধরা হবে। এতে বাংলাদেশে মৎস্য খাতের সাথে জড়িত জনগোষ্ঠীর অধিকারসমূহ প্রসঙ্গে বিদ্যমান নীতি, আইন নিয়ে আলোকপাত করা হবে। দেখা হবে এই অধিকার বিষয়ে বাংলাদেশে কী কী সমস্যা রয়েছে। এজন্য এই স্টাডি প্রতিবেদন দুটি মূল ধারায় আলোকপাত করবে, একটি হচ্ছে বিদ্যমান প্রকাশনার আলোকে সামুদ্রিক মৎস্য খাতের একটি সামগ্রিক ধারণা প্রদান করা এবং দ্বিতীয়ত, উপকূলীয় মৎস্য খাতে জেলে নারীদের অবস্থা এবং তাদের অধিকার ও ক্ষমতায়নের পরিস্থিতি সংক্রান্ত জরিপ/ স্টাডির প্রাপ্ত তথ্যসমূহ।
৪. স্টাডির সীমাবদ্ধতা
এই স্টাডির প্রধান সীমাবদ্ধতা ছিল কোভিড-১৯ এর কারণে যাতায়াতে নানা বাধা থাকায় মাঠ পর্যায়ে পরিদর্শন ও সরাসরি তথ্য সংগ্রহ। স্থানীয় পর্যায়ে স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবকদের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করার ক্ষেত্রে তথ্য সংগ্রহকারী স্বেচ্ছাসেবকদের নিজেদের জনগোষ্ঠী ও মৎস্য আহরণ সংক্রান্ত নিজস্ব ধ্যান ধারণা যুক্ত হয়েছে, যা হয়ত ক্ষেত্রবিশেষে সংগৃহীত তথ্যে প্রভাব সৃষ্টি করতে পারে। পূর্বধারণা দ্বারা প্রভাবিত ও চালিত হওয়া থেকে তথ্য সংগ্রহকে মুক্ত রাখতে, তথ্য ও উপাত্তকে কোনো পূর্ব-নির্ধারিত দৃষ্টিভঙ্গি ও মতামত থেকে মুক্ত রাখতে তথ্য সংগ্রহকারীদেরকে একটি পরিচিতি প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়।
সাক্ষাৎকার গ্রহন ও তাদের সাথে দেখা করার ব্যাপারটা অনেক চ্যালেঞ্জিং ছিল সারা দেশে কোভিড পরিস্থিতি জনিত কারণে পরিবহন সীমিত থাকায়।
এই স্টাডি পরিচালনার ক্ষেত্রে অন্য যেসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হয়েছে-
ফরমের বেশ কিছু ঘর পূরণ করা হয়নি, খালি রয়ে গেছে।
অধারাবাহিক বা পরষ্পরবিরোধী তথ্য রয়েছে।
কিছু যৌক্তিক কাঠামোগত শূন্যস্থান খালি রাখা হয়েছে।
বার্ষিক দিনপঞ্জির তথ্য অধ্যায়ে অনেক অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে।
সাক্ষাৎকার গ্রহনকারী অনেক সেকশন পূরণ করেননি
এসব ঘাটতি পূরন করতে কিছু তাৎক্ষণিক সতর্কতা অবলম্বন করা হয়েছে। যেমন, সংগৃহীত তথ্য সতর্কতার সাথে যাচাই করা হয়েছে, প্রয়োজনে আবার তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে।
৫. ধারণাগত কাঠামো
বাংলাদেশে মৎস্যজীবী জনগোষ্ঠীকে নিয়ে কোনো স্টাডি করতে গেলে প্রথমেই যে প্রশ্নটি সামনে আসবে তা হচ্ছে- মৎস্যজীবী কারা? আইএলও কনভেনশন, ২০০৭ (১৮৮ ধারা) অনুযায়ী, “মৎস্যজীবী বা জেলে হচ্ছেন সেই ব্যক্তি, নারী বা পুরুষ, যিনি একটি মাছ ধরার নৌকায় কোনো না কোনো কাজে নিযুক্ত বা সম্পৃক্ত। মাছ ধরার নৌকায় কর্মরত কোনো ব্যক্তি যাকে সংগৃহীত মাছের অংশ তার পারিশ্রমিক হিসেবে দেয়া হয়, তাকেও এর আওতায় ধরা হয়। এই কনভেনশনের ভিত্তি অনুসারে, মৎস্যজীবী হিসেবে গণ্য করা হয় না যাদেরকে তারা হচ্ছেন, নৌকার চালক, নাবিক, সরকারি স্থায়ী চাকুরে, জেটিতে কর্মরত নৌকা সংক্রান্ত ব্যক্তি, মৎস্য পরিদর্শক, মাছ ধরে তীরে আনার পর তা নিয়ে যারা কাজ করেন, যেমন মৎস্য প্রক্রিয়াজাতকরণ বা বিপণন ইত্যাদি কর্মকা-ে জড়িত ব্যক্তি।” বাংলাদেশ মৎস্য অধিদপ্তর মৎস্যজীবীদের একটি সংজ্ঞা নির্ধারণ করেছে। এতে বলা হয়েছে, “যারা জীবিকা হিসেবে সারাবছর বা নির্দিষ্ট ঋতূতে (মাছ ধরার উপযোগী) নৌকা নিয়ে জাল বা অন্যান্য সরঞ্জাম (বড়শি, পলো, টেটা, উচা, চাই, কচ ইত্যাদি) দিয়ে মাছ ধরে থাকেন তারাই মৎস্যজীবী বা জেলে।” এই সংজ্ঞার ভিত্তিতে মৎস্য অধিদপ্তর জেলেদের পরিচয়পত্র প্রদান করে এবং মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞার সময় তার ভিত্তিতে জেলেদের রেশন সহায়তা প্রদান করে থাকে। তবে, বাংলাদেশে এই সংজ্ঞা অনুযায়ী নৌকা, জাল বা অন্যান্য সরঞ্জাম ব্যবহারকারীর বাইরেও জেলে সম্প্রদায় রয়েছেন। মাঠ পরিদর্শনে দেখা যায়, মৎস্য অধিদপ্তরের নির্ধারিত সংজ্ঞা অনুযায়ী প্রকৃত জেলের বাইরেও বেশ কয়েক ধরনের জেলে রয়েছেন, যা বিবেচনায় নেয়া দরকার। অল্প কথায়, মুটামুটি তিন ধরনের জেলে রয়েছেন, তাদের মধ্যে এক প্রকার হচ্ছে যারা গভীর সমুদ্রে মাছ ধরতে যান এবং বছরে নয় মাস এই কাজে যুক্ত থাকেন। আরেক প্রকার জেলে আছেন যারা তীরেই অবস্থান করেন এবং দৈনিক ভিত্তিতে কাজ কাজ করেন। তৃতীয় দলটি হচ্ছে, ছোট দল তৈরি করে যৌথভাবে কাজ করেন। বে অব বেঙ্গল লার্জ মেরিন ইকোসিস্টেম (বিওবিএলএমই) এর সংজ্ঞা অনুযায়ী, ক্ষুদ্র মাপের মৎস্যজীবী হচ্ছেন তারা যারা ২৫ মিটারের গড়পড়তা দৈর্ঘের চেয়ে ছোট নৌকায় কাজ করেন , যদিও এই নির্দিষ্ট সংজ্ঞা নিয়ে বিশ্ববাণিজ্য সংস্থায় বিতর্ক চলমান আছে। অবশ্য, এই সংজ্ঞায় উপকূলীয় জীবিকায় বিদ্যমান সুস্পষ্ট অভ্যন্তরীন পার্থক্য এই সংজ্ঞায় ধরা পড়ে না। বাংলাদেশ, ভারত ও শ্রীলংকায় ক্ষুদ্র মৎস্যজীবী বলতে বুঝায় মূলত দুইটি শ্রেণীকে: ধরন ক- ব্যক্তি পর্যায়ের মোটরবিহীন নৌকা, ঐতিহ্যবাহী মোটরচালিত নৌকা এবং আধুনিক মোটর চালিত নৌকা যা উপকূলে তীরের কাছাকাছি মাছ ধরায় নিয়োজিত এবং ধরন খ- অত্যাধুনিক উপকূলীয় চিংড়ি ট্রলার এবং গভীর সমুদ্রে মাছ ধরার নৌকা।
ব্যক্তি পর্যায়ের মৎস্যজীবী বা জেলে হচ্ছেন তারা, যারা তুলনামূলক কম মাত্রার প্রযুক্তি ব্যবহার করেন, যেমন ছোট ডিঙ্গি, ইঞ্জিন ছাড়া বা ছোট ইঞ্জিনচালিক নৌকা ব্যবহার করেন, বড় ও শক্তিশালী ইঞ্জিন চালিত নৌকা নয়, এবং প্রচলিত ধরনের মাছ ধরার উপকরণ ব্যবহার করেন, যেমন হাতে চালানো জাল বা ঘের জাল। এই মৎস্যজীবীরা উপকূলীয় জনগোষ্ঠীর গুরুত্বপূর্ণ আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিনিধিত্ব করেন । এই স্টাডির জন্য প্রযোজ্য হিসেবে মৎস্যজীবী বা জেলের একটি সংজ্ঞা আমরা নির্ধারণ করেছি, যেখানে জেলে বলতে বোঝানো হচ্ছে, যারা সমুদ্রে মাছ ধরেন এবং টানা পাঁচ দিন মাছ ধরার জন্য সমুদ্রে অবস্থান করেন। অন্য কথায়, জেলে বলতে আমরা ক্ষুদ্র পরিসরের পরিবার ভিত্তিক জেলেকে (ধৎঃরংধহধষ ভরংযবৎং) বুঝিয়েছি। জেলে সম্প্রদায় বলতে এখানে একই সাথে দরিদ্র ব্যক্তি বা পরিবার ভিত্তিক জেলে যেমন বোঝানো হয়েছে, তেমনি বাণিজ্যিক জেলেও বোঝানো হয়েছে।
এই স্টাডিতে, শুধুমাত্র ব্যক্তি পর্যায়ের জেলেদের পরিবারকেই নির্বাচন করা হয়েছে। এই স্টাডিতে মৎস্যজীবী জনগোষ্ঠীর বা জেলে সম্প্রদায়ের সংজ্ঞা নির্ধারণ করা হয়েছে এভাবে, জেলে (ধৎঃরংধহধষ ভরংযবৎং) বলতে বোঝানো হয়েছে যারা বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরেন এবং মাছ ধরার জন্য ইঞ্জিনচালিত ঐতিহ্যবাহী কাঠের নৌকায় করে সমুদ্রে যান এবং অন্তত টানা পাঁচদিন সেখানে অবস্থান করেন। আর বাণিজ্যিক মৎস্যজীবী বলতে বোঝানো হয়েছে, যারা বাণিজ্যিক মাছ ধরার জাহাজ নিয়ে সমুদ্রে মাছ ধরতে যান এবং অন্তত অর্ধমাস সেখানে অবস্থান করেন ও গভীর সমুদ্রে মাছ শিকার করেন। কাজেই, যখন মৎস্যজীবী জনগোষ্ঠী তথা জেলে সম্প্রদায় কথাটি বলা হবে, তখন এই ব্যক্তি জেলেদের দল এবং বাণিজ্যিক মৎস্য শিকারীদের দল উভয়কেই বোঝানো হবে। ব্যক্তি জেলেদের পরিবারের নারী সদস্যদের থেকে এই স্টাডির জন্য তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে।
৬. পদ্ধতি
৬.১ তথ্য সংগ্রহ
জরিপের সময় যে পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে সেগুলো হচ্ছে: (১) গ্রন্থ পর্যালোচনা, (২) বাংলাদেশেবিদ্যমান নীতি ও আইনী কাঠামো, (৩) নির্বাচিত ব্যক্তি ও তথ্যদাতাদের সাথে ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকার এবং মূল তথ্যদাতার সাক্ষাৎকার (কেআইআই), এবং (৪) নির্বাচিত জড়িত ব্যক্তিদের নিয়ে এফজিডি।
৬.১.১ প্রাথমিক তথ্য সংগ্রহ
প্রাথমিক তথ্য সংগ্রহের জন্য দুইটি মাঠপর্যায়ের এলাকা বেছে নেয়া হয়েছে যাতে একটা ভৌগলিক সমন্বয় ঘটে এবংযা থেকে সংখ্যাতাত্ত্বিক ও গুণতাত্ত্বিক উভয় তথ্য সংগৃহীত হয়। সংখ্যাতাত্ত্বিক তথ্য সংগ্রহের জন্য কেস স্টাডি জরিপ করা হয়েছে। পর্যবেক্ষণ, কাঠামোবদ্ধ ও অ-কাঠামোবদ্ধ উভয় পদ্ধতির সাক্ষাৎকার, মূল তথ্যদাতার সাক্ষাৎকার (কেআইআই) ইত্যাদির সমন্বয়ে এই বেজলাইন জরিপের মূল তথ্যভান্ডার গড়ে তোলা হয়েছে। এফজিডি এবং মূল তথ্যদাতা সাক্ষাৎকার উভয়ের ক্ষেত্রেই কিছু বদ্ধ ও খোলা প্রশ্ন ও চেকলিস্ট তৈরি করা হয়।
৬.১.২ প্রাথমিক তথ্য সংগ্রহের জন্য জরিপ কৌশল
প্রাথমিক তথ্য সংগ্রহের জন্য দুই ধরনের জরিপ কৌশল নির্মাণ করা হয়। একটি ছিল গুণতাত্ত্বিক ও অপরটি সংখ্যাতাত্ত্বিক তথ্য সংগ্রহ পদ্ধতি।
সংখ্যাতাত্তিক তথ্যের জন্য একটি প্রায়-কাঠামোবদ্ধ প্রশ্নপত্র তৈরি করা হয় জেলে সম্প্রদায়ের পরিবারের নারী সদস্যদের জন্য। এই একই প্রশ্নপত্র দিয়ে তিনটি ভিন্ন স্থানে জরিপ সম্পাদন করা হয়। একটি সরল এবং কার্যকর ক্ষোভ নিরসন সেকশন সাক্ষাৎকারে যুক্ত করা হয়। প্রশ্নপত্রের মধ্যে সম্মতি অনুমোদন অংশও অন্তর্ভুক্ত ছিল।
কৌশল চূড়ান্ত করে ফেলার পর তিনটি ভৌগলিক স্থানে আলাদা জরিপ টিম নিয়োগ করা হয়। তিনটি জেলার জন্য পৃথক জেলা সমন্বয়কারী নির্বাচন করা হয়। নিযুক্ত সমন্বয়কারীগন আলাদা আলাদাভাবে স্থানীয়ভাবে ১৫ জন তথ্য সংগ্রহকারী নিয়োগ করে জরিপ টিম গঠন করেন। তথ্য সংগ্রহকারী ও জরিপকারীদের নিয়ে একটি দিনব্যাপী প্রশিক্ষণ আয়োজন করা হয়। নিয়োগপ্রাপ্ত সকলেই স্থানীয় বাসিন্দা এবং তথ্য সংগ্রহের কাজে পরীক্ষিত। স্যাম্পল কাঠামো অনুসরন করে তথ্য সংগ্রহকারীরা তৃণমূল পর্যায় থেকে তথ্য সংগ্রহের জন্য ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ে কাজ করেন।
গুণতাত্ত্বিক অনুসন্ধানের জন্য দুইটি চেকলিস্ট তৈরি করা হয়। একটি হচ্ছে সাক্ষাৎকারদাতাদের তালিকা তৈরির জন্য এবং অন্যটি হচ্ছে এলাকা এবং সাক্ষাৎকার চলাকালীন আলোচনার বিষয়বস্তু অনুসরনের জন্য। সাক্ষাৎকারদাতাদের মধ্যে সামুদ্রিক মৎস্য খাতে যুক্ত অধিকার-প্রাপক ও অধিকার সংরক্ষণকারী উভয়কেই অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এই তালিকার বাইরে, আরেকটি চেকলিস্ট তৈরি করা হয় যাতে সেখানে মানবাধিকারের বিষয়গুলো মোটা দাগে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। মূল তথ্যদাতার সাক্ষাৎকার ও এফজিডির জন্য আলোচ্যসূচির এই চেকলিস্ট পৃথকভাবে তৈরি করা হয়। সাক্ষাৎকারে স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবীরা সহায়তা করেন এবং গবেষণা দল সাক্ষাৎকার পরিচালনা করেন।
৬.১.৩ প্রশ্নপত্র তৈরির মিশ্র পদ্ধতি
কোস্ট ট্রাস্ট ও তার গবেষণা ও এমইএএলের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তাদের সহায়তায় মাঠকর্ম সম্পাদনের জন্য প্রতিটি জেলায় একজন করে প্রাসঙ্গিক যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কর্মী নিয়োগ করা হয়। এই কর্মকর্তারাই জরিপ প্রশ্নপত্র তৈরির কৌশলের একেবারে শুরু থেকে মাঠ পর্যায়ে চূড়ান্ত পর্যায় পর্যন্ত জড়িত ছিলেন। মাঠকর্ম শুরুর আগে জড়িত কর্মীদের জন্য একটি একদিনের প্রশিক্ষণ আয়োজন করা হয়, যেখানে প্রশিক্ষণার্থীদের জন্য শ্রেণীকক্ষ পাঠ এবং মাঠ পর্যবেক্ষণ উভয় ধরনের আয়োজনই ছিল। প্রশ্নপত্র তৈরির পর ১০ জন পৃথক উত্তরদাতার সাথে সেগুলো পরীক্ষা করে দেখা হয়। মাঠ পরীক্ষণের পর সেগুলো কর্মীদের মাঝে বিতরণ করা হয় এবং কাজসমূহ নিবিড় ফলোআপের মধ্যে রাখা হয়, এর ভিত্তিতে কিছু প্রশ্ন পুনর্নির্মাণ করা হয়, নতুন প্রশ্ন অন্তর্ভুক্ত করা হয় এবং বেশ কিছু প্রশ্ন বাদ দেয়া হয়। শেষ পর্যন্ত একটি চূড়ান্ত খসড়া তৈরি করা হয় এবং মাঠে প্রেরণ করা হয়।

৬.১.৪ পরোক্ষ তথ্য
এই স্টাডিতে বিভিন্ন উৎস থেকে যেসব সেকেন্ডারি ডাটা অর্থাৎ পরোক্ষ তথ্য ব্যবহার করা হয়েছে, তার মধ্যে আছে একাডেমিক রচনা, প্রকাশিত বা অপ্রকাশিত প্রতিবেদন, সরকারি অফিস, এনজিও ও অন্যান্য পক্ষের ওয়েব সাইটে সংরক্ষিত পরিসংখ্যান ইত্যাদি। আইনী কাঠামো ও জেলে সম্প্রদায়সহ মোট চারটি বিষয়ভিত্তিক ক্ষেত্রে এই পরোক্ষ তথ্য কাজে লাগানো হয়েছে।
সামুদ্রিক মৎস্য খাতের জন্য আইনী কাঠামো রেফারেন্স হিসেবে পর্যালোচনা করা হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে সকল অ্যাক্ট, আইন, নীতি এবং বিধান। অর্থাৎ বিদ্যমান সকল আইনী কাঠামো বিশ্লেষণ করে এর মধ্য থেকে তাদের জন্য মানবাধিকার ও জেন্ডার ভিত্তিক অধিকারের আওতা বিবেচনায় নেয়া হয়েছে। নিচে পর্যালোনাকৃত আইনী কাঠামোসমূহের একটা তালিকা দেয়া হল।
জাতীয় আইন, নীতি ও নিয়ন্ত্রণ বিধানসমূহ
– বাংলাদেশ সংবিধান
– বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ (সংশোধনী ২০১৮)
– বাংলাদেশ শ্রম বিধান ২০১৫
– জাতীয় শ্রম নীতি ২০১২
– কর্মক্ষেত্রে স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা নীতি ২০১৩
– জাতীয় মৎস্য নীতি ১৯৯৮
– জাতীয় মৎস্য কৌশল ২০০৬
– বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন করপোরেশন অ্যাক্ট ১৯৭৩
– মেরিন ফিশারিজ অর্ডিন্যান্স ১৯৮৩
– দ্য প্রটেকশন এন্ড কনজারভেশন অব ফিশ অ্যাক্ট ১৯৭৩
– জাতীয় পানি নীতি ১৯৯৯
– সরকারি জলমহাল ব্যবস্থাপনা নীতি ২০০৯
– বাংলাদেশ পরিবেশ সুরক্ষা আইন ১৯৯৫
জাতীয় প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ও প্রতিষ্ঠানসমূহ
– মৎস্য অধিদপ্তর (ডিওএফ)
– বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএফআরআই)
– বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন করপোরেশন (বিএফডিসি)
– বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বোর্ড
– ভূমি ব্যবস্থাপনা এবং ভূমি সংস্কার বিভাগ
– এক্সটারনাল রিসোর্স ডিভিশন
– এক্সপোর্ট প্রমোশন ব্যুরো
– ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানসমূহ
ব্যক্তি পর্যায়ের মৎস্য জীবিকা ও জেলে সম্প্রদায় সংক্রান্ত পরোক্ষ তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে তিনটি মূল উৎস থেকে- বই, জার্নাল এবং প্রতিবেদনসমূহ। আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক সামুদ্রিক সম্পদ প্রশাসন কর্তৃক প্রাতিষ্ঠানিকভাবে প্রকাশিত বই এবং তার অধ্যায়সমূহ, সমুদ্রের নিচের জীবন নিয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণা, বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে নীতি সংক্রান্ত চ্যালেঞ্জসমূহ এবং সমুদ্রের স্থায়িত্বশীলতা বিষয়ে অব্যবস্থাপনা ও চ্যালেঞ্জসমূহ নিয়ে প্রকাশিত গ্রন্থ এর মধ্যে রয়েছে। বই ছাড়াও প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদন এই স্টাডিকে আরও সমৃদ্ধ করেছে। প্রকাশিত আর্টিকেলসমূহ নেয়া হয়েছে বিভিন্ন উচ্চ প্রভাবসম্পন্ন জার্নাল, ওপেন একসেস জার্নাল এবং বিভিন্ন গবেষণা ও একাডেমিক প্রকাশিত জার্নালসমূহ থেকে। বই এবং জার্নাল থেকে তথ্য সংগ্রহ ছাড়াও এই স্টাডির ঋণ রয়েছে বাংলাদেশ সরকারের প্রকাশনাসমূহ, যেমন পরিসংখ্যান ইয়ারবুক ২০১৮, খানা জরিপ ২০১৬, মৎস্য অধিদপ্তরসহ অন্যান্য সরকারি অফিস থেকে সংগৃহিত তথ্য। ট্রেড ইউনিয়ন এবং এনজিও থেকেও বিভিন্ন তথ্য পর্যালোচনা করা হয়েছে এই স্টাডিতে। পরোক্ষ তথ্যের উৎস হিসেবে সংবাদপত্রকেও বিবেচনায় নেয়া হয়েছে। এছাড়াও বিভিন্ন জাতীয়, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠানের প্রকাশনা থেকেও পরোক্ষ তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে জাতিসংঘের প্রকাশনা, এফএও-র প্রতিবেদন, বিওবিএলএমই প্রকাশনা এবং বিআইএলএস প্রতিবেদন। ইকোফিশ, ওয়ার্ল্ডফিশ এবং অন্য যারা এ বিষয়ে কাজ করেছেন তাদের প্রকল্প প্রতিবেদনও পরোক্ষ তথ্যের অন্যতম উৎস।
৬.২ গ্রন্থ পর্যালোচনা
বিভিন্ন গবেষণা প্রকাশনা নিয়ে নিবিড় পর্যালোচনা করা হয়েছে এই কাজের জন্য। উদ্দেশ্য ছিল তিনটি প্রধান বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করা; (১) শ্রমের জেন্ডার দৃষ্টিকোণ এবং নিরাপদ কাজের পরিবেশ, (২) নারীর ক্ষমতায়ন, যথা- সিদ্ধান্ত গ্রহন ক্ষমতা, সামাজিক স্বীকৃতি, এবং (৩) এই বিষয়ে তথ্যের বিভিন্ন উৎস অনুসন্ধান।
৬.৩ বাংলাদেশে বিদ্যমান নীতি ও আইনী কাঠামো
বাংলাদেশে বর্তমানে চলমান সরকারি নীতি ও আইনী কাঠামোতে জেন্ডার ফোকাস নিয়ে নিবিড়ভাবে গুগল সার্চ পরিচালনা করা হয়। নারীর অগ্রগতি সম্পর্কে বাংলাদেশ সরকারের জাতীয় নীতিতে এবং বিশেষ নির্দেশনাসমূহ সম্পর্কে পরিচিত হতে এবং সে সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করাই ছিল এ কাজের মূল উদ্দেশ্য।
৬.৪ ব্যক্তির সাক্ষাৎকার এবং মূল তথ্যদাতার সাক্ষাৎকার (কেআইআই)
মোট ১,২০০টি পরিবারের সাক্ষাৎকার গ্রহন করা হয়। লক্ষিত ধারণার একটি উত্তম বোঝাপড়া গড়ে তোলার জন্য যথেষ্ঠ তথ্য সংগ্রহ করাই ছিল এই সাক্ষাৎকার গ্রহনের মূল উদ্দেশ্য। সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে উত্তরদাতার পরিবার সম্পর্কে এই স্টাডির উদ্দেশ্যের সাথে সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্য বের করে আনার জন্য ব্যক্তি সাক্ষাৎকারের জন্য প্রশ্নপত্র প্রস্তুত করা হয়। যথাযথ নিয়ম অনুসারে মূল তথ্যদাতা ও মূল পক্ষসমূহের সাক্ষাৎকার গ্রহন করা হয়, যাতে জেলেদের অধিকার ও চ্যালেঞ্জসমূহ সম্পর্কে, বিশেষ করে নারী জেলেদের সম্পর্কে তাদের ধারণা বের করে আনার জন্য।
৬.৫ এফজিডি
প্রাথমিক তথ্য সংগ্রহ ও প্রকাশিত গ্রন্থসমূহ পর্যালোচনা করার পর এফজিডি (ফোকাস গ্রুপ ডিসকাশন) সম্পন্ন করা হয়, যার মাধ্যমে সংগৃহীত প্রাথমিক তথ্য যাচাই ও অনুমোদন করা হয়।
৬.৬ তথ্য বিশ্লেষণ
সকল তথ্য সংগ্রহের পর তা এক্সেল ফাইলে এন্ট্রি করা হয়, সংক্ষিপ্তসার করা হয় এবং বিশ্লেষণ করা হয়। এরপর সেগুলোকে (বক্তব্য, সারণী ও গ্রাফিক) নানা ফরমে উপস্থাপন করা হয় যাতে উপকূলীয় মৎস্য খাতে গবেষিত এলাকায় নারীর সক্রিয় অংশগ্রহনের বা কার্যকর যুক্ততার চিত্রগুলো তুলে ধরা যায়।
৬.৭ যাচাই কর্মশালা
তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণের পর তিনটি জেলা পর্যায়ের কর্মশালা আয়োজন করা হয়। ৭ অক্টোবর ২০২০ কক্সবাজারে মৎস্য অধিদপ্তরের কনফারেন্স হলে, ২০ অক্টোবর ২০২০ তারিখে ভোলার জেলা প্রশাসকের কনফারেন্স হলে এবং ২২ অক্টোবর ২০২০ বাগেরহাটের উদয়ন কনফারেন্স হলে কর্মশালাগুলো অনুষ্ঠিত হয়। জরিপের ফলাফল সেখানে বিভিন্ন অংশগ্রহনকারীদের সামনে উপস্থাপন করা হয় ও বিশদ আলোচনা করা হয়। জেলা পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তা, জেলে সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি এবং উপস্থিত অন্যান্য পক্ষ প্রাপ্ত ফলাফল আলোচনা করে তা অনুমোদন করেন এবং কিছু সুপারিশ তুলে ধরেন।
৭. জরিপের এলাকা
স্টাডির জন্য বাংলাদেশের তিনটি উপকূলীয় জেলার তিনটি উপজেলা বাছাই করা হয়। সমুদ্রগামী জেলেরা সাধারণত বাংলাদেশের উপকূলীয় জেলাগুলোতেই বাস করে। ১২টি উপকূলীয় জেলার মধ্যে উপকূলবর্তী উপজেলাগুলোতেই সমুদ্রগামী জেলেদের বসবাস বেশি। এ কারণেই, সমুদ্রগামী জেলেদের নিয়ে জরিপ করতে হলে উপকূলীয় জেলা বিশেষ করে যেসব এলাকায় সামুদ্রিক মাছ সংগ্রহ বেশি এবং বসবাসকারী জেলেদের সংখ্যা বেশি, এমন এলাকাতেই দৃষ্টিনিবদ্ধ করা জরুরি। ভোলা, বরগুনা ও কক্সবাজার- এই তিনটি উপকূলীয় জেলায় সামুদ্রিক মৎস্য সংগ্রহ তুলনামূলকভাবে বেশি। তবে, ভোলায় অভ্যন্তরীন মৎস্যজীবীর সংখ্যাও অনেক বেশি। এই তিনটি জেলার মধ্যে থেকে জরিপের জন্য ভোলা ও কক্সবাজার জেলাকে বাছাই করা হয়। ভোলা ও কক্সবাজারের পাশাপাশি তৃতীয় উপকূলীয় জেলা হিসেবে বাগেরহাটকে বেছে নেয়া হয়।

কক্সবাজার সদর শরণখোলা বাগেরহাট সদর ভোলা সদর

বাংলাদেশে এই তিনটি জেলাই সামুদ্রিক মৎস্য সংগ্রহের জন্য বেশ বিখ্যাত। এই ৩ জেলার ৪টি উপজেলাধীন ৭টি ইউনিয়ন থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। উপজেলা হচ্ছে জেলার অধীন এবং ইউনিয়ন হচ্ছে বাংলাদেশের স্থানীয় সরকারের প্রথম স্তরের প্রশাসনিক কাঠামো। একটি ইউনিয়ন কয়েকটি গ্রাম নিয়ে গঠিত। নিচের সারণীতে জরিপকৃত জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়নের নামসমূহ উল্লেখ করা হল।
জেলা উপজেলা ইউনিয়ন
কক্সবাজার কক্সবাজার সদর খুরুশকুল, পিএমখালি
ভোলা ভোলা সদর ধনিয়া, ভেদুরিয়া
বাগেরহাট বাগেরহাট সদর, শরণখোলা যাত্রাপুর, ষাটগম্বুজ, সাউথখালি

জরিপকৃত এলাকাগুলো সমুদ্র থেকে ইলিশ মাছ সংগ্রহের জন্য বিখ্যাত। নয়টি উপকূলীয় জেলা থেকে বছরে মোট ২ লক্ষ ৮৪ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন ইলিশ (মোট ইলিশের প্রায় ৫৫.০১%) ধরা পড়ে। এর মধ্যে র‌্যাংকিংয়ে বরগুনা রয়েছে ২য় স্থানে (৬৬ হাজার ৯১৭ মেট্রিক টন, ২৩.৫৩% ইলিশ) এবং কক্সবাজার ৫ম স্থানে (৩৬ হাজার ৮০০ মেট্রিক টন, ১২.৯৩% ইলিশ)। বরিশাল বিভাগের মধ্যে ভোলা এবং বরগুনাই সবচেয়ে বেশি ইলিশ সরবরাহ করে থাকে। গত অর্থবছরে ভোলা থেকে ১ লক্ষ ৬১ হাজার ৮৩২ মেট্রিক টন ইলিশ সরবরাহ করা হয় এবং বরগুনা থেকে ৭০ হাজার ২৩৭ টন । অন্যদিকে, বাগেরহাট হচ্ছে চিংড়ি চাষের অন্যতম প্রধান এলাকা ।
জরিপকৃত এলাকায় বসবাসরত মানুষের অধিকাংশই, প্রায় ৪০% জেলে। জরিপকৃত এলাকার মোট পরিবারের (ঘর) সংখ্যা ২০,০৯৯, যার মধ্যে জেলে পরিবার ৭,৯৯৪ (প্রায় ৩৯.৭৮%)। ভোলায় ৭০% জেলে পরিবার এবং কক্সবাজারে এই অনুপাত ৬৬.৯৯%। নিচের সারণীতে নির্বাচিত এলাকায় মোট কতটি পরিবার এবং কতটি জেলে পরিবার বসবাস করে।
জেলা উপজেলা ইউনিয়ন মোট পরিবারের সংখ্যা মোট জেলে পরিবারের সংখ্যা
বাগেরহাট বাগেরহাট সদর ষাট গম্বুজ ৪,৭২৩ ১,৮১৭
যাত্রাপুর ৪,০৩৬ ৮৬৬
শরণখোলা সাউথখালি ৭,৩১৫ ২,৫৪৬
ভোলা ভোলা সদর ধনিয়া ১,১৫৫ ৭৬৫
ভোলা সদর ভেদুরিয়া ৭৫০ ৫৮০
কক্সবাজার
কক্সবাজার সদর খুরুশকুল ১,১৪০ ৯৫৫
কক্সবাজার সদর পিএমখালি ৯৮০ ৪৬৫
সর্বমোট ২০,০৯৯ ৭,৯৯৪

কক্সবাজার
কক্সবাজার জেলা যোগাযোগের দিক থেকে একটি বিচ্ছিন্ন এলাকাই শুধু নয়, সেই সাথে এর ভৌগলিক চেহারাও ভিন্ন। কক্সবাজার জেলা ইউএনডিপি-র বিবেচনায় বাংলাদেশের ২০টি ‘অগ্রাধিকার জেলা’র তালিকার অন্যতম। এই তালিকায় অন্তর্ভুক্তিতে প্রতীয়মান হয়, কক্সবাজার জেলায় রয়েছে অতি দারিদ্র এবং বন্যা, ঘুর্নিঝড় প্রবনতার পাশাপাশি এটি দুর্গম এলাকার মধ্যে পড়ে । এমডিজি অর্জনের দিক থেকে ধরতে গেলে কক্সবাজার বাংলাদেশের নি¤œতম অর্জনের জেলাগুলোর একটি। ২০০৫ সালে যখন বাংলাদেশে দারিদ্রের অনুপাত ছিল ৪০% তখন তা কক্সবাজারে ছিল ৫২%। কক্সবাজারে উখিয়া উপজেলায় দারিদ্র বৃদ্ধি পেয়ে ২০০০ সালের ৫৩.১% থেকে ২০০৫ সালে ৬৮%-এ উপনীত হয়। টেকনাফ উপজেলার দারিদ্র বৃদ্ধি পেয়ে ২০০০ সালের ৫৮.৮% থেকে ২০০৫ সালে ৭৩.১% উপনীত হয় । বাংলাদেশে উপকূলবর্তী মৌসুমী ঝড়ের আঘাতে সবচেয়ে বিপর্যস্ত ১৫টি জেলার মধ্যে কক্সবাজার একটি ।
কক্সবাজার একটি উপকূলীয় জেলা। এর মোট আয়তন হচ্ছে ২,৪৯১.৮৫ বর্গকিলোমিটার (৯৬২.১ বর্গমাইল)। কক্সবাজারের অর্থনীতি মূলত কৃষিনির্ভর। ৪৪.১৫% জমিই কৃষি জমি যেখানে নানা ধরনের ফসল ফলে, স্থানীয় ও উচ্চ ফলনশীল জাতের ধান, গম, সবজি, মশলা, অর্থকরী ফসল, ডাল, পান এবং অন্যান্য। এই জেলায় বিভিন্ন প্রজাতির মাছ প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়, বিশেষ করে সামুদ্রিক মাছের প্রাচুর্য উল্লেখযোগ্য। সামুদ্রিক মাছ ছাড়াও নদী, খাল বিল ও বর্ষা মৌসুমে ধানের ক্ষেতেও অনেক প্রজাতির মাছ ধরা পড়ে। শুটকি মাছ এখানকার জেলেদের একটি গুরুত্বপূর্ণ আয়ের উৎস। স্থানীয় ও দুর্লভ প্রজাতির নানা ধরনের মাছ এখানে পাওয়া যায়, বিশেষ করে কার্প জাতীয় মাছ, মাগুর এবং অন্যান্য ছোট মাছ। মাছ এখানকার সংস্কৃতিতে একেবারে অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং এই এলাকার অর্থনীতিতে এর অবদান অনেক গুরুত্বপূর্ণ।

বাগেরহাট
বাগেরহাট জেলাটি বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিম অংশে বঙ্গোপসাগরের তীরে অবস্থিত, যার ব্যাপক সীমানা জুড়ে রয়েছে সুন্দরবন। বাগেরহাটের অর্থনীতিও কৃষি শাসিত, তবে এতে সুন্দরবন ও মোংলা বন্দরেরও অবদান রয়েছে। মোট মালিকানাধীন জমির ৬৮.৫৭% কৃষি জমি যেখানে নানা ধরনের ফসল ফলে। যার মধ্যে রয়েছে, স্থানীয় ও উচ্চ ফলনশীল জাতের ধান, গম, পাট, সবজি, মশলা, ডাল, তেলবীজ, আখ, নারকেল ও অন্যান্য। এই জেলায় নানা জাতের মাছের প্রাচুর্য রয়েছে। সামুদ্রিক মাছ ছাড়াও নদী, মোহনা, খাল বিল ও বর্ষা মৌসুমে ধানের ক্ষেতেও অনেক প্রজাতির মাছ ধরা পড়ে। ফসলের পাশাপাশি পশুপালন ও মাছচাষ প্রধান গৃহস্থালি আয়। প্রচুর জলাভূমি থাকায় এই জেলায় মাছের উৎপাদন ভালো। সহজলভ্য মাছের জাতগুলোর মধ্যে রুই (ষধনবড় ৎড়যরঃধ), কাতলা (ঈধঃষধ পধঃষধ), মৃগেল (ঈরৎৎযরহঁং সৎরমধষধ), কালিবাউশ (ষধনবড় পধষনধংঁ), শিং (যবঃবৎড়ঢ়হবঁংঃবং ভড়ংংরষরং), মাগুর (ঈষধৎরধং নধঃৎধপযঁং) ইত্যাদি পাওয়া যায় এখানকার অসংখ্য খালে ও বিলে। নদী ও পুকুরের আরো অনেক প্রজাতির মিঠা পানির মাছও এই জেলায় পাওয়া যায়। এর মধ্যে অন্যতম- কোরাল/ ভেটকি (খধঃবং পধষপধৎরভবৎ), ধাইন, চিতল (ঘড়ঃড়ঢ়ঃবৎড়ঁং পযরঃধষধ), ঘোনা, আইড় (গুংঃঁং ধড়ৎ), বাঘাড় (ইধমধৎরঁং নধমধৎরঁং), পাঙ্গাস (চধহমধংরঁং ঢ়ধহমধংরঁং), বোয়াল (ডধষষধমড় ধঃঃঁ), রিটা, বাইম (গধংঃধপবসনবষঁং ধৎসধং), চাপিলা (এঁফঁংরধ পযধঢ়ৎধ), ভাংনা (খধনবড় নড়মধ), নান্দাইল (খধনবড় হধহফরহধ), বাচা (ঊঁঃৎড়ঢ়রপযঃুং াধপযধ), পোয়া (চধসধ ঢ়ধসধ) গোলসা (গুংঃঁং নষববশবৎর), টেংড়া (গুংঃঁং ারঃঃধঃঁং), চান্দা (গবহব সঁপঁষধঃধ), রূপচান্দা (চড়সঢ়ধং পযরহবহংরং), কাঁচকি, বেলে (এষড়ংংমড়নরঁং মরঁৎরং), ভেদা, বাতাসি, ঘাউসা, কাকিলা, ফলি (ঘড়ঃড়ঢ়ঃবৎঁং হড়ঃড়ঢ়ঢ়ঃবৎঁং), টাটকিনি (ঈৎড়ংংপযবরষঁং ষধঃরঁং), পাবদা (ঙসঢ়ড়শ ঢ়ধনফধ), চেলা (ঈযবষধ ঈধপযরঁং), গাংচেলা, গজার (ঈযধহহধ সধৎঁষরঁং), কই (অহধনঁং ঃবংঃঁফরহবঁং), খলিসা (ঈধষরংধ ভধংপরধঃধ), পুঁটি (ইধৎনঁং ঢ়ঁহঃর), মালান্দি, বাঁশপাতা (উধহরড় ফবাধৎরড়), কাঁকড়া (ঝপুষষধ ংবৎৎধঃধ), বাগদা ও গলদা চিংড়ি। অবশ্য এসব মাছের অনেক প্রজাতিই আজকাল প্রায় বিলুপ্ত, বিশেষ করে বিলের মাছ। অতিরিক্ত মাছ শিকার ও ফসলের ক্ষেতে কীটনাশক প্রয়োগ ও অন্যান্য কারণে এসব মাছ বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। বাণিজ্যিকভাবে কিছু অপরিচিত মাছ চাষ শুরু হয়েছে, যেমন গ্রাস কার্প (ঈঃবড়ঢ়যধৎুহমড়ফড়হ রফবষষধ), সিলভার কার্প (ঐুঢ়ড়ঢ়যঃযধষসরপঃযুং সড়ষরঃৎরী), তেলাপিয়া (ঙৎবড়পযৎড়সরং সড়ংংধসনরপঁং), নাইলোটিকা (ঙৎবড়পযৎড়সরং হরষড়ঃরপঁং) ইত্যাদি। বাগেরহাট জেলা তার চিংড়ি ঘেরের জন্য বিখ্যাত ।
ভোলা
ভোলা জেলা পৃথিবীর একটি বৃহৎ নদীবিধৌত বদ্বীপ। ভোলার অর্থনীতি মূলত কৃষিনির্ভর। ৬৪.০১% মালিকানাধীন জমিই কৃষিজমি। যেখানে নানা ধরনের ফসল উৎপন্ন হয়। এর মধ্যে রয়েছে স্থানীয় ও উচ্চ ফলনশীল জাতের ধান, গম, পাট, সুপারি, সবজি, মশলা, ডাল, কিছু অর্থকরি ফসল ও অন্যান্য। নানা জাতের নদী ও সামুদ্রিক মাছের প্রচুর্য রয়েছে এই দ্বীপে। সামুদ্রিক মাছ ছাড়াও নদী, মোহনা, খাল বিল ও বর্ষা মৌসুমে ধানের ক্ষেতেও অনেক প্রজাতির মাছ ধরা পড়ে। বিখ্যাত মাছ ইলিশ প্রচুর পরিমাণে ধরা পড়ে। মিঠা পানির মাছের প্রজাতির মধ্যে রয়েছে রুই, কাতলা, মৃগেল, কালবাউশ, আইড়, ঘইনা, শোল, বোয়াল, গাগার, গোলসা, কই, শিং, মাগুর ইত্যাদি। কৃষির পাশাপাশি পশুপালন ও মাছ চাষ এখানকার পরিবারগুলোর মূল গৃহস্থালি আয়। এই জেলায় প্রাপ্ত মাছের মধ্যে রয়েছে স্থানীয় প্রজাতি, আমদানিকৃত প্রজাতি, লোনা পানির ও সামুদ্রিক মাছ।

৮. নমুনা সংখ্যা এবং ডিজাইন
জরিপের নমুনা হিসেবে আমরা তিনটি উপজেলার সবগুলো ইউনিয়নকে বিবেচনা করেছি। এসব উপজেলায় বসবাসরত জেলেদের জনসংখ্যার উপর ভিত্তি করে নমুনার আকার নির্ধারণ করা হয়েছে।

হ = নমুনা সংখ্যা, ঘ= মোট পরিবারের সংখ্যা, হড় =৩৮৪.১৬, ১.৯৬ হতে ৯৫% হচ্ছে কনফিডেন্স লিমিট এবং কাক্সিক্ষত মাত্রার তাৎপর্যপূর্ণতা হচ্ছে ০.০৫ বা ৫%.
নির্বাচিত এলাকায় বসবাসরত মোট জেলে পরিবারের সংখ্যা ৭,৯৯৪। সূতরাং জরিপ এলাকার জন্য নমুনা সংখ্যা বা ‘হ’ হচ্ছে ৩৬৬.৫৪ (৭৯৯৪ ী ৩৮৪.১৬/ ৭৯৯৪+৩৮৪.১৬)। অন্যদিকে, জেলাভিত্তিক ‘হ’ বা নমুনা সংখ্যা হচ্ছে বাগেরহাট ২৩৯.৭৬, ভোলা ২৯৮.৮১ এবং কক্সবাজার ৩০২.৩৬। যদিও সারা বিশ্বে স্বীকৃত ৫% ত্রুটিসহ হিসাব করে মোট জনসংখ্যার অনুপাতে নমুনা সংখ্যা বের করা হয়েছে ৩৮৩.৪৮, আমরা এই জরিপের জন্য নমুনা সংখ্যা নির্ধারণ করে ১,২০০। গড়ে প্রতি জেলায় ৪০০ জন করে হিসাব করে। বেশি পরিমাণ নমুনা সংখ্যা গ্রহন করা হয়েছে সকল ধরনের ত্রুটির সম্ভাব্য ঝুঁকি পরিহার করার জন্য।
এই ১,২০০ ব্যক্তি হবেন জেলে পরিবারের নারী সদস্য। জনসংখ্যা হিসেবে নির্ধারিত নমুনা সংখ্যা প্রতি জেলায় সতর্কতার সাথে বন্টন করা হয়। সাক্ষাৎকার গ্রহনের জন্য ব্যক্তি নির্বাচনের সময় একটি সরল পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়েছে। গ্রামের বা পাড়ার প্রতিটি কিনারা এবং মাঝখান থেকে বাড়ি বাছাই করা হয়েছে যাতে সকল ধরনের শ্রেণী পেশা ও অর্থনৈতিক অবস্থার মানুষ এতে অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। এছাড়াও প্রতিজন সাক্ষাৎকারদাতাকে নির্বাচন করা হয়েছে উক্ত পরিবারে তাদের ভূমিকা, বয়স ইত্যাদি বিবেচনা করে।
জেলা উপজেলা জেলে পরিবার সংখ্যা
ইউনিয়ন ১ ইউনিয়ন ২ ইউনিয়ন ৩ মোট সূত্র অনুযায়ী নমুনা সংখ্যা প্রকৃত নমুনা সংখ্যা
কক্সবাজার কক্সবাজার সদর ৯৫৫ ৪৬৫ ১৪২০ ৩০২ .৩৬ ৪০০
ভোলা ভোলা সদর ৭৬৫ ৫৮০ ১৩৪৫ ২৯৮.৮১ ৪০০
বাগেরহাট সদর ১৮১৭ ৮৬৬ ২৫৪৬ ৫২২৯ ২৩৯.৭৬ ৪০০

৯. স্টেকহোল্ডার সম্পৃক্তকরণ
গুরুত্বপূর্ণ স্টেকহোল্ডারদের এই গবেষণায় সম্পৃক্ত করা ছিল এই কাজের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তাদের সাথে পরিচিত হওয়া এবং পরষ্পর সম্পর্কে জানাবোঝার জন্য চারটি সভার আয়োজন করা হয় জরিপের কাজ শুরুর আগে। অধিকার এবং চর্চার বিষয়গুলো চিহ্নিত করতে সম্ভাব্য সকল স্টেকহোল্ডারকে একত্রিত করে আলোচনা ও মতবিনিময় করা হয়। কর্মশালাগুলো আয়োজন করা এমনভাবে যাতে এই গবেষণাটি স্থানীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের অংশগ্রহনে ও জ্ঞাতসারে সম্পন্ন হয়। এই প্রেরণাটি মাথায় রেখেই স্বেচ্ছাসেবক ও তথ্য সংগ্রহকারীদের বাছাই করা স্থানীয় পর্যায় থেকে। গবেষণার আওতা ও লক্ষ্যসমূহ জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অংশগ্রহনের মাধ্যমে পর্যালোচনা ও মূল্যায়ন করা হয়। এই পর্যালোচনার ভিত্তিতে একই পদ্ধতিতে মাঠ পর্যায়ের স্টেকহোল্ডারদের সম্পৃক্ত করা হয়।

দ্বিতীয় অধ্যায়
মৎস্য খাত, সামুদ্রিক মৎস্য খাত, মানবাধিকার এবং মৎস্য খাতে নারী

১. বাংলাদেশে মৎস্য খাত
মৎস্য বাংলাদেশের একটি অন্যতম উৎপাদনশীল ও সম্ভাবনাময় খাত যা গত কয়েক দশক ধরে দেশের অর্থনীতিতে ক্রমবর্ধমান অবদান রেখে যাচ্ছে। এই খাতটি দেশের জাতীয় জিডিপিতে ৩.৫৭% অবদান রাখছে এবং কৃষি জিডিপি-তে এর অনুপাত এক-চতুর্থাংশের বেশি (২৫.৩%)। দেশের মোট প্রাণীজ প্রোটিনের চাহিদার অন্যতম জোগান (প্রায় ৬০%) আসে এই খাত থেকে (মৎস্য অধিদপ্তর, ২০১৮)। বাংলাদেশ ব্যাপক মাত্রায় ও বৈচিত্রময় মৎস্য সম্পদের আশির্বাদপুষ্ট। এই খাতটি মূলত দুইটি প্রধান ভাগে বিভক্ত, অভ্যন্তরীন ও সামুদ্রিক। অভ্যন্তরীণ মৎস্য খাত আবার দুইটি উপখাতে বিভক্ত- অভ্যন্তরীন মৎস্য শিকার ও মৎস্য চাষ। অভ্যন্তরীন মৎস্য শিকারের এলাকা হচ্ছে নদী, মোহনা, খাল, বিল, বর্ষাপ্লাবিত সমভূমি, হাওড়, সুন্দরবন ও কাপ্তাই লেক। অন্যদিকে মৎস্য চাষের ক্ষেত্রগুলো হচ্ছে পুকুর, মৌসুমী জলাশয়, বাওড়, চিংড়ি ঘের, খাঁচা ও অন্যান্য পদ্ধতি মাছ চাষ ইত্যাদি। সামুদ্রিক মৎস্য আহরণের মধ্যে রয়েছে শিল্প বাণিজ্যিক (ট্রলার) ও জেলে সম্প্রদায়ের মৎস্য আহরণ (কাঠের নৌকা)।
দেশের বৈচিত্রপূর্ণ মৎস্য সম্পদ মূলত তিনটি ভাগে বিভক্ত। (১) অভ্যন্তরীন মৎস্য শিকার, (২) অভ্যন্তরীন মৎস্য চাষ, এবং (৩) সামুদ্রিক মৎস্য আহরণ। অন্যান্য খাতের মধ্যে জাতীয় পর্যায়ে সামুদ্রিক মৎস্য আহরণের উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে। নদীর পরেই সামুদ্রিক মৎস্য আহরণ বাংলাদেশের মোট মৎস্য উৎপাদনে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে। প্রায় ২০ প্রজাতির সামুদ্রিক মাছের মধ্যে ইলিশের অবদান বেশি। এই খাতের প্রবৃদ্ধি অনেক সম্ভাবনাময় এবং স্থায়িত্বশীল (এফএসবি, ২০১৮)।
সমুদ্রে অবস্থান ও কর্মকা-ের জন্য সমুদ্রগামী জেলেরা সমুদ্রের স্থায়িত্বশীলতার জন্য একটি জরুরি অংশিদার। সামুদ্রিক মৎস্য খাতে নানা শ্রেণীর জেলে ও বৈচিত্রময় প্রকারের মাছ ধরার উপকরণ ও হাতিয়ারের ব্যবহার রয়েছে। বাংলাদেশ মৎস্য পরিসংখ্যান (২০১৭-১৮) অনুযায়ী, শিল্প ভিত্তিক মৎস্যজীবী (ট্রলার) যারা বৃহৎ জাহাজ যেমন ট্রলার ব্যবহার করে, যেখানে বাণিজ্যিক মৎস্য কারবারীরা মাছ ধরার বড় নৌকা ব্যবহার করে মৎস্য শিকারের জন্য। সাধারণভাবে বললে, মৎস্য খাতে এদের মাধ্যমে উচ্চ প্রযুক্তি, বিনিয়োগ ও প্রভাব রয়েছে। অন্যদিকে, জেলে সম্প্রদায়ের মাধ্যমে যে মৎস্য আহরণ চলে, সেখানে ক্ষুদ্রাকৃতির কাঠের নৌকা ব্যবহার করা হয়। ক্ষুদ্র পরিসরে, সহজ প্রযুক্তি ও অল্প বিনিয়োগের মাধ্যমে ব্যক্তিকেন্দ্রিক জেলে পরিবারের মাছ ধরার চর্চা চলমান রয়েছে।
বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা নতুন করে নির্ধারণের পর সামুদ্রিক মৎস্য খাত নতুন মনোযোগ পেয়েছে। ২০১২ সালের ১৪ মার্চ সামুদ্রিক আইনের আন্তর্জাতিক ট্রাইবুনালের মাধ্যমে মিয়ানমারের সাথে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমার একটি সুরাহা হয়। ট্রাইবুনালের সিদ্ধান্তে বাংলাদেশ বঙ্গোপসাগরে আরো নটিক্যাল মাইল সম্প্রসারনের মাধ্যমে সমুদ্রের নিবিড় অর্থনীতি ও আন্তসীমানার অধিকার অর্জন করে। মহীসোপানের পর ২০০ মাইল এবং সেন্ট মার্টিন দ্বীপের চারপাশে আন্তর্জাতিক জলসীমার মধ্যে আরো ১৯.৩১ কিলোমিটার (১২ নটিক্যাল মাইল) বর্ধিত সীমানার অধিকার অর্জন করে বাংলাদেশ (মৎস্য অধিদপ্তর, বার্ষিক প্রতিবেদন, ২০১৭)।
এই রায়ের পর থেকে এই সম্পদে প্রবেশাধিকার ও উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য অনেক উদ্যোগ গ্রহন করা হয়। এফএও-র তহবিল সহায়তায় মৎস্য অধিদপ্তরের মাধ্যমে ২০১৬ সালের নভেম্বরে “টেকনিক্যাল সাপোর্ট ফর স্টক এসেসমেন্ট অব মেরিন ফিশারিজ রিসোর্সেস ইন বাংলাদেশ” শীর্ষক একটি প্রকল্প হাতে নেয়া হয় এবং ‘আর ভি মীন সন্ধানী’ নামের একটি জাহাজ নিয়ে সমুদ্রে জরিপ করা হয়। বঙ্গোপসাগরে চিংড়ি, সমুদ্রের তলদেশে মাছের প্রজাতি, অন্যান্য সামুদ্রিক সম্পদ এবং জীববৈচিত্রসহ মোট ১৬টি বিষয় নিয়ে জরিপ করা হয়। এতে ৩৪৯ প্রজাতির মাছ, চিংড়ি, কাঁকড়া ও অন্যান্য সামুদ্রিক প্রাণীর অবস্থান চিহ্নিত করা হয়।

২. সামুদ্রিক মৎস্য খাত
বাংলাদেশের সমুদ্র ও উপকূলের পরিবেশ পৃথিবীর অন্যতম সেরা সমৃদ্ধ বাস্তুসংস্থান, যার রয়েছে অত্যন্ত উচ্চ উৎপাদন সম্ভাবনা । বঙ্গোপসাগরে উত্তর কোণে অবস্থিত বাংলাদেশ পৃথিবীর প্রান্তিক উপকূলীয় দেশসমূহের একটি। বঙ্গোপসাগরের সাপেক্ষে পশ্চিম, উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমে রয়েছে ভারত এবং পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্বে রয়েছে মিয়ানমার। বাংলাদেশের উপকূল রেখার দৈর্ঘ ৭১০ কিলোমিটার , যা সাতক্ষীরায় অবস্থিত সুন্দরবনের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণ থেকে শুরু করে দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলে টেকনাফ পর্যন্ত বিস্তৃত । বাংলাদেশের সামুদ্রিক এলাকার আয়তন হচ্ছে ১৬৬,০০০ বর্গকিলোমিটার, যার মধ্যে ১০ মিটারের কম গভীরতাসম্পন্ন এলাকার আয়তন রয়েছে ২৪ হাজার বর্গকিলোমিটারেরও বেশি । ২০১২ সালে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সামুদ্রিক সীমা সংকট নিয়ে সামুদ্রিক আইন সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক ট্রাইবুনালের রায়ের পর এবং ২০১৪ সালে ভারত-বাংলাদেশ সমুদ্রসীমা নিয়ে জাতিসংঘের (টঘঈখঙঝ) আরবিট্রাল ট্রাইবুনালের মাধ্যমে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সমুদ্র থেকে ১১৮,৮১৩ বর্গকিলোমিটারেরও বেশি এলাকার উপর সার্বভৌম অধিকার অর্জন করেছে যার মধ্যে ২০০ নটিক্যাল মাইল রয়েছে নিবিড় অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং চট্টগ্রাম উপকূল থেকে মহীসোপান ঢালের ৩৫৪ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত বিস্তৃত সমুদ্র তলদেশে অবস্থিত সকল প্রাণ ও অ-প্রাণ সম্পদের উপর এই অধিকার অর্জন করেছে ।
বাংলাদেশের উপকূলের ভৌগলিক গঠনের উপাদানসমূহের মধ্যে রয়েছে উপকূলীয় সমভূমির দ্বীপ, জোয়ার প্লাবিত সমতল ভূমি, অগভীর সমুদ্র এবং অদূরবর্তী জলাভূমি, যাকে বৃহৎ ভৌগলিক অঞ্চলে ভাগ করা যায়। (১) পশ্চিমাঞ্চল যা উপকূলের তেঁতুলিয়া নদী থেকে শুরু করে পশ্চিমে আন্তঃসীমান্ত নদী হাড়ভাঙ্গা পর্যন্ত বিস্তৃত। পশ্চিমাঞ্চলের মধ্যে রয়েছে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠা ম্যানগ্রোভ বন, সুন্দরবন। (২) মধ্যাঞ্চল যা তেঁতুলিয়া নদী থেকে বড় ফেনী নদী পর্যন্ত পূর্ব-পশ্চিমে বিস্তৃত, এর মধ্যে রয়েছে মেঘনার মোহনা যেখানে জিবিএম (গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা) রিভার সিস্টেমের মূল স্রোত প্রবাহিত। (৩) পূর্বাঞ্চল, যা বড় ফেনী নদী থেকে বদর মোকাম, দক্ষিণে মূলভূমির শেষবিন্দু, পর্যন্ত বিস্তৃত। এই অংশটি মুটামুটি অভিন্ন ও ভাঙন থেকে মুক্ত, গড়ে উঠেছে কাদাযুক্ত সমভূমি ও বালিময় সৈকত দিয়ে, যার মধ্যে রয়েছে মাতামুহুরির তীরবর্তী কিছুটা ক্ষয়প্রাপ্ত প্রাকৃতিক ম্যানগ্রোভ বন। এই অঞ্চলে রয়েছে কর্ণফুলি, সাঙ্গু, মাতামুহুরি, বাঁকখালি ও নাফ নদীর প্রবাহিত স্রোতের পানি।
পরিচালনার দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশের সামুদ্রিক মৎস্য আহরণ তিনটি স্তরে বিভক্ত। (১) উপকূল থেকে ৪০ মিটার গভীর পর্যন্ত অঞ্চল যেখানে মূলত সাধারণ মাছ ধরার নৌকা পরিচালনা করা হয়; (২) ৪০ থেকে ২০০ মিটার গভীর এলাকা যেখানে মাঝারি আকৃতির ট্রলার পরিচালনা করা হয় এবং (৩) ২০০ মিটার গভীর থেকে নিবিড় অর্থনৈতিক অঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকা যেখানে লং লাইনার ট্রলার পরিচালনা করা হয় । এই অঞ্চলে পরিচালনা করার জন্য সরকার অনুমোদিত ট্রলারের সংখ্যা ২৪২টি ।
উৎপাদনের পরিপ্রেক্ষিতে সামুদ্রিক মৎস্য খাত মৎস্য উৎপাদনের ভিত্তিতে শ্রেণীকৃত। মোট বার্ষিক সামুদ্রিক মৎস্য উৎপাদন হয় ৬.৫৫ লাখ মেট্রিক টন (এর মধ্যে শিল্পভিত্তিক উৎপাদন ১.২ লাখ মেট্রিক টন এবং জেলে সম্প্রদায় দ্বারা উৎপাদন ৫.৩৫ লাখ মেট্রিক টন) এবং এর প্রবৃদ্ধি ২.৭১% । ইলিশ বাংলাদেশের জাতীয় মাছ। বাংলাদেশের মোট মৎস্য উৎপাদনের ১২.০৯% আসে ইলিশ থেকে। গৃহীত বিভিন্ন উদ্যোগের ফলে ২০০৩-০৪ সালের ইলিশ উৎপাদন ১.৯৯ লাখ মেট্রিক টন থেকে বেড়ে ২০১৭-১৮ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ৫.১৭ লাখ মেট্রিক টনে। ইলিশ উৎপাদনের প্রবৃদ্ধির হার প্রায় ৪.১৯%। এখানে উল্লেখ করা দরকার যে, ইলিশকে বাংলাদেশের ভৌগলিক সূচক হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। বাংলাদেশের আরেকটি প্রধান রপ্তানী পণ্য হচ্ছে চিংড়ি। গলদা ও বাগদা চিংড়ির শিকার ও চাষসহ মোট উৎপাদন ২০০৩-০৪ সালের ১.৬ লাখ মেট্রিক টন থেকে বেড়ে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এসে দাঁড়িয়েছে ২.৫৪ লাখ মেট্রিক টনে। এর প্রবৃদ্ধির হার ৩.২৩%।
বাংলাদেশের মৎস্য ও সামুদ্রিক মৎস্য খাত (মেট্রিক টন)
খাত ২০১৭-১৮ ২০১৬-১৭
উৎপাদন উৎপাদন বৃদ্ধি প্রবৃদ্ধির হার (%) উৎপাদন প্রবৃদ্ধির হার (%)
নদী ২৩২,০৬৬ ১৪,৭৬৬ ৬.৮ ২১৭,৩০০ ৫৪.৫১
সুন্দরবন ৬৩২ ৪৬৩ ২৭৩.৯৬ ১৬৯ ৫৫.০৪
সামুদ্রিক শিল্প উৎপাদন ১১,০৬০ ৪,১১২ ৫৯.১৮ ৬,৯৪৮ ৮৮.০৪
সামুদ্রিক জেলে দ্বারা উৎপাদন ২৭৩,৪৪০ ১,৪৪০ ০.৫৩ ২৭২,০০০ ৮.৫৮
মোট ৫১৭,১৯৮ ২০,৭৮১ ৪.১৯ ৪৯৬,৪১৭ ২৫.৬৯

২.১ জেলে সম্প্রদায়ের মৎস্য উৎপাদন
জেলে সম্প্রদায় হচ্ছেন মূলত ক্ষুদ্র পরিসরের মৎস্যজীবী, যারা ঐতিহ্যবাহী মাছ ধরার কৌশল ব্যবহার করেন এবং ক্ষুদ্র নৌকা নিয়ে মাছ শিকার করেন প্রধানত নিজেদের জীবন যাপন ও স্থানীয় বাজারের চাহিদা মেটাতে । অবশ্য, এই স্টাডির সংজ্ঞার প্রসঙ্গে বলা হয়েছিল, জেলে সম্প্রদায় হচ্ছে সেই মৎস্যজীবী যারা সমুদ্রে মাছ ধরেন এবং এর জন্য অন্তত টানা পাঁচ দিন সমুদ্রে অবস্থান করেন এবং এ কাজের জন্য তারা ইঞ্জিন চালিত ঐতিহ্যবাহী কাঠের নৌকা ব্যবহার করেন।
২.২ জেলে সম্প্রদায়ের নৌকা ও সরঞ্জাম
সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ৬৭,৬৬৯টি যান্ত্রিক ও অযান্ত্রিক নৌকা বঙ্গোপসাগরে ঐতিহ্যবাহী মৎস্য শিকারে নিয়োজিত। এই নৌকাগুলোতে তুলনামূলকভাবে খুবই সাধারণ হাতিয়ার বা সরঞ্জাম ব্যবহার করে মাছ শিকার করা হয়। ঘেরা জাল, ফাঁস জাল ও বড় ফাঁকের জাল বিভিন্ন ধরনের নৌকায় ব্যবহার করা হয়। ইঞ্জিনবিহীন নৌকা সাধারণত ৩-৫ জন জেলে মিলে উপকূলের অদূরে দৈনিক ভিত্তিতে মাছ ধরার কাজে ব্যবহৃত হয়। ইঞ্জিনচালিত নৌকা সাধারণত ৪০ মিটার গভীর এলাকায় ৫-৭ দিন সময় নিয়ে মাছ ধরতে যায়, তাদের নৌকায় মাছ সংরক্ষণের জন্য বরফ ও অন্যান্য ব্যবস্থা থাকে। নৌকার আকার ভেদে এতে ১০ থেকে ২৫ জন জেলে শ্রমিক থাকে এবং তারা নানা ধরনের যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে থাকেন ।
সমুদ্রগামী জেলেদের মৎস্য শিকারে সাধারণত ১৬টির বেশি ধরনের মাছ শিকারের হাতিয়ার ও সরঞ্জাম ব্যবহার করা হয়ে থাকে, যার মধ্যে ঘের জাল, টানা জাল, মোহনায় ব্যবহার উপযোগী ফাঁস জাল, সামুদ্রিক ফাঁস জাল, বড় ফাঁকের জাল ইত্যাদিই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। এসব যন্ত্রপাতির পার্থক্য নির্ণয় করা যায় প্রতি খ্যাপে শিকারের পরিমাণের উপর (কেজি/জাল/দিন)। অবশ্য এসব সরঞ্জাম একসাথে বৃহৎ পরিমাণ মাছ ধরার কাজে ব্যবহার করা হয় (ঘোষ ও অন্যান্য, ২০১৬)। আরো রয়েছে মোহনার উপযোগী ফাঁস জাল, সামুদ্রিক ফাঁস জাল, বড় ফাঁকের জাল, ছোট ফাঁকের ঘন জাল, টং জাল, রগ জাল এবং পেকুয়া জাল।
২০১৫-১৬ সালে উপকূলে সামুদ্রিক মাছ নেমেছে মোট ৩১,৭৫৪.৬৩ মেট্রিক টন, যা ২০১৬-১৭ সালে ১.৫৩% বৃদ্ধি পায়। মাছ ধরার সরঞ্জাম অনুযায়ী হিসাব করলে দেখা যায় এ সময়ে সবচেয়ে বেশি মাছ ধরা পড়েছে সামুদ্রিক ফাঁস জালে, যার অনুপাত প্রায় ৭৩.৪৫%।

২.৩ জেলে সম্প্রদায়ের মৎস্য আহরণে বিভিন্ন পক্ষ ও তাদের ভূমিকা
জেলে সম্প্রদায়ের দ্বারা পরিচালিত প্রথাগত মৎস্য কার্যক্রমে মাঠে পাঁচ ধরনের মানুষ যুক্ত। এর মধ্যে রয়েছে মহাজন, আড়ৎদার, নৌকার মালিক, মাঝি ও জেলে। এদের মধ্যে মহাজন এবং আড়ৎদার (মাছ আড়তের মালিক) মূলত বিনিয়োগ করেন এবং পুরো মৎস্য বাজার নিয়ন্ত্রণ করেন। মাঝি ও জেলেরা সমুদ্রে মাছ ধরতে যান। নৌকার মালিকরা এই দুই পক্ষের মাঝে মধ্যস্বত্বভোগী হিসেবে কাজ করেন। নিচের সারণীতে তাদের কার্যক্রম ও ভূমিকা বিষয়ে বিস্তারিত দেয়া হল।
ক্ষেত্র বিষয় মহাজন আড়ৎদার/ মাছ ব্যবসায়ী নৌকা মালিক সারেং/ মাঝি জেলে (গওহর, শূন্যভাগি, মাল্লা
মাছ বাজার ভূমিকা/ অবদান নৌকা ও মাছ ব্যবসায় বিনিয়োগ করেন নৌকা ও জেলের উপর বিনিয়োগ, আড়ৎ/ বাজার নিয়ন্ত্রণ করেন নৌকায় বিনিয়োগ করেন, যাত্রার জন্য তৈরি করেন যাত্রার নেতৃত্ব দেন, জেলেদের নেতা দৈনিক শ্রমিক হিসেবে মাছ ধরেন, মুনাফায় সবচেয়ে কম ভাগী
আর্থিক ব্যবস্থা (ব্যাংক) সম্পত্তি ও যোগ্যতা থাকায় সরাসরি ব্যাংকে সুযোগ আছে মর্টগেজ না থাকায় অনেক ক্ষেত্রে ব্যাংকে সরাসরি সুযোগ নাই আড়ৎদার থেকে ঋণ নেন আড়ৎদারের কাছে যেতে হয় ঋণের জন্য নৌকা, সরঞ্জাম বা জেলেদের উপর ব্যাংক বিনিয়োগ করে না
আর্থিক ব্যবস্থা (এনজিও) এনজিও থেকে অর্থ নেন না, কারণ তাদের বড় বিনিয়োগ দরকার মাঝে মাঝে এনজিও থেকে ঋণ নেন ঋণ নেন, তবে বড় অংকের হলে নিয়মিত ঋণ নেন এনজিওর ক্ষুদ্র ঋণের নিয়মিত সদস্য
মুনাফার ভাগ একক ক্রেতা, একমুখী নিয়ন্ত্রন, আড়ৎদার তার থেকে ঋণ নেন বলে তার কাছে সব মাছ বিক্রি করতে বাধ্য নৌকার মালিকের সাথে চুক্তি অনুযায়ী বিনিয়োগের ৫-১০% মুনাফা সব খরচ বাদে আয়ের ৫০% তার বাকি ৫০% এর দুই-তৃতীয়াংশ (৩৩%) ভাগ নেন মুনাফার ১৭% ১০-১৫ জন মাল্লা ভাগ করে নেন
শ্রম বাজার পক্ষ ও ভূমিকা সরাসরি যুক্ত নন সরাসরি শ্রম বাজার নিয়ন্ত্রণ করেন, দাদন পদ্ধতি কিছু বাঁধা শ্রমিক থাকে সারেং-এর সুপারিশে মাল্লারা অনেক সময় আড়ৎদারের হাতে থাকেন অগ্রিম শ্রম বিক্রি করেন
২.৪ প্রথাগত জেলে ব্যবস্থা
প্রথাগতভাবে বহু বছর ধরে জেলে সম্প্রদায় যে পদ্ধতিতে মাছ ধরে আসছে তা মূলত অভিজ্ঞতা লব্ধ জ্ঞান অনুসরণ করে। সমুদ্রে মাছ আহরণের ক্ষেত্রে তেমন কোনো কারিগরি সহায়তা নাই কিংবা নিরাপদে সরে যাবার পথ নেই। জেলেরা সমুদ্রে তাদের অবস্থান নির্ণয় করার জন্য দুইটি পদ্ধতি ব্যবহার করে। হাতের মাপে বাম (এক বাম মানে প্রায় ১২ ফুট) মেপে সাগরের গভীরতা মাপার মাধ্যমে এবং সমুদ্রের পানির রঙ দেখে। অবশ্য, পানির রঙ তেমন নির্ভরযোগ্য নয়। কারণে জোয়ার ভাটার সময় স্রোতের কারণে পানির রঙ পরিবর্তিত হয়ে যায়। এভাবে পানির রঙ দিয়ে অবস্থান চিহ্নিত করা কঠিন ও ঝুঁকিপূর্ণ। রাতের বেলা তারার মাধ্যমে তারা অবস্থান নির্ণয় করে।
জাল ফেলার সময় বেশ কয়েকটি চিহ্ন তারা মনে রাখে। যেমন পানির রঙ। ইলিশ মাছ থাকলে পানিতে লালচে রঙ দেখা যায়। অন্যান্য মাছের ক্ষেত্রে পানিতে বুদবুদ থাকে। আবহাওয়ার পূর্বাভাসের জন্যও তারা স্রেফ পূর্ব অভিজ্ঞতার উপর নির্ভর করে। পানি শান্ত হয়ে থাকা বা পানি থেকে তাপ বের হওয়া, কিছু কিছু পোকা উড়াউড়ি করা, বাতাসের ধরন, গতি ও দিক ইত্যাদি।
২.৫ সামুদ্রিক সম্পদের সুযোগ পাওয়ার ধরন ও পদ্ধতি
মাছ ধরার জন্য শিল্পভিত্তিক ট্রলার ও ইঞ্জিনচালিত প্রযুক্তিসম্পন্ন নৌকার লাইসেন্স লাগে। শিল্পভিত্তিক ট্রলারের ক্ষেত্রে মৎস্য অধিদপ্তরের অধীনে সামুদ্রিক মৎস্য দপ্তরের যাত্রার অনুমোদন (সেইলিং পারমিশন) আবশ্যক। শিল্প ভিত্তিক এসব ট্রলার মাছ বা চিংড়ি ধরার জন্য অনুমতি পায় সে এলাকা ৪০ মিটারে অধিক গভীর হলে। যন্ত্রচালিত নৌকাকে ৪০ মিটারের কম গভীর এলাকায় মাছ ধরার অনুমোদন দেয়া হয়। মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য (মৎস্য পরিদর্শন ও মান নিয়ন্ত্রণ) বিধান ১৯৯৭ ট্রলারের জন্য নিরাপদ সিফুড উৎপাদনের নির্দেশনা প্রদান করে থাকে।
মৎস্য অধিদপ্তরের অধীনে সামুদ্রিক মৎস্য দপ্তর (এমএফও) যন্ত্রচালিত মৎস্য নৌযানের লাইসেন্স প্রদান করে। তবে, তার জন্য এমএফও থেকে পরিদর্শন সার্টিফিকেট লাগে এবং মেরিন মারকেন্টাইল অফিস বা এমএমও থেকে নিবন্ধনের কাগজ লাগে। সম্প্রতি ওয়ান স্টপ সার্ভিস প্রদানের জন্য কিছু মৎস্য এলাকায় এমএফও এবং এমএমও একসঙ্গে লাইসেন্স প্রদানের কাজ করছে।
সামুদ্রিক সম্পদে সুযোগ পাবার (লাইসেন্সিং) পদ্ধতি
স্টেকহোল্ডার লাইসেন্সের ধরন মন্ত্রণালয়, বিভাগ লাইসেন্স প্রাপ্তির পদ্ধতি ফি (টাকা)
বোট/
ট্রলার নৌকা ও সরঞ্জামের ফিটনেস মারকেন্টাইল মেরিন বিভাগ, নৌ মন্ত্রণালয় চট্টগ্রামের আঞ্চলিক কার্যালয় ১৫ হাজার, বাস্তবে ৪০ হাজার লাগে কোস্ট গার্ড/ নৌ পুলিশ
সমুদ্রে মাছ ধরার লাইসেন্স সামুদ্রিক মৎস্য দপ্তর এমএমও-র লাইসেন্সের উপর নির্ভর করে, সেটা থাকলে তারা পরিদর্শন করেন না ৭,০০০ (তবে, বাস্তবে ১৪-১৫ হাজার লাগে) কোস্ট গার্ড/ নৌ পুলিশ
হারবার পাশ মৎস্য অধিদপ্তর পরিদর্শন লাগে না ৮৫০, বাস্তবে ২,৬০০ কোস্ট গার্ড
আড়ৎদার মৎস্য ব্যবসায়ের লাইসেন্স, বিএফডিসি ঘাট (ল্যান্ডিং স্টেশন) বিএফডিসি আবেদন পত্রের সাথে জাতীয় পরিচয় পত্র ও ট্রেড লাইসেন্স খুচরা ৯২০, পাইকারি ১,৯০৫
বাস্তবে বেশি লাগে বিএফডিসি, ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা
জেলে পরিচয় পত্র মৎস্য অধিদপ্তর ইউনিয়ন পরিষদের রেফারেন্স লাগে ফ্রি কোস্ট গার্ড/ নৌ পুলিশ
নাগরিকত্ব সনদ ইউনিয়ন পরিষদ ফ্রি
(বাস্তবে ৩০-৪০ হাজার লাগে) কোস্ট গার্ড/ নৌ পুলিশ

লাইসেন্সের পাশাপাশি একটি নতুন আইনী নির্দেশনা আরোপ করা হয়েছে এফএও থেকে, যার নাম ক্যাচ সার্টিফিকেট রেগুলেটরি ফ্রেমওয়ার্ক (সিসিআরএফ)। এই নির্দেশনা অনুযায়ী সামুদ্রিক প্রাণ সম্পদ সুরক্ষার জন্য অবৈধ, অপ্রদর্শিত ও অনিয়ন্ত্রিত (আইইউইউ) মৎস্য আহরণ নিয়ন্ত্রণ, বন্ধ ও বাতিল করতে পারে। সামুদ্রিক মৎস্য দপ্তর এই আইইউইউ বাস্তবায়নের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত এবং তাদের প্রতিমাসে বঙ্গোপসাগরে অন্তত ৫টি শিল্পভিত্তিক ট্রলার পরিদর্শন করে আইইউইউ নজরদারি করার কথা। মৎস্য রপ্তানীকারকদের জন্য এই লাইসেন্স অপরিহার্য।
২.৬ প্রথাগত মৎস্যজীবী জেলে সম্প্রদায়
প্রথাগতভাবে মৎস্য জীবিকার সাথে জড়িত জেলে সম্প্রদায় বঙ্গোপসাগরের উপকূল বা তার নিকটবর্তী মোহনায় বাস করেন। আদমশুমারির তথ্য অনুযায়ী জেলে সম্প্রদায় মৎস্য কর্মকান্ডের সাথে সারাবছর যুক্ত থাকেন। বেশিরভাগই, প্রায় ৯৮% জেলে মুসলিম। বাকিরা হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত, যারা আবার দুইটি গোত্রে বিভক্ত- ডোম আর জলদাস। জরিপভুক্ত এলাকায় প্রাপ্ত জেলে সম্প্রদায় বেশিরভাগই স্থানীয় বাসিন্দা যারা এখানেই জন্মগ্রহন করেছেন। কেউ কেউ হয়ত একই জেলার অন্য উপজেলা বা ইউনিয়ন থেকে অভিবাসী হয়ে চলে এসেছেন। জেলেপল্লীতে দেখা গেছে ৯০% জেলে নিজেদের ভিটায় বাস করছেন, বাকিরা খাস জমিতে বা অন্য কোনোভাবে বাস করছেন। এই জনগোষ্ঠীর মধ্যে দেখা গেছে ৩% পরিবারে পুরোপুরি প্রতিবন্ধী বা আংশিক প্রতিবন্ধী সদস্য রয়েছেন।
জেলেদের পরিবারের মূল আয়ের উৎস মাছ ধরা। ৯৫% জেলেই মৎস্যজীবিতার উপর নির্ভর করেন। পরিবারগুলোর বার্ষিক আয় ৭৫ হাজার টাকা থেকে ১ লক্ষ টাকা। জেলেদের অনেকেই সমুদ্র থেকে ফিরেই মজুরি পান (৩১.৭%) এবং বাকিরা মাছ বিক্রির পর (৪৫.১%)। মাছ ধরা থেকে যে আয় হয় তা দিয়ে বছরের এক চতুর্থাংশ ভালোভাবে চলে। মন্দার সময় তাদের ঋণ করতে হয়। ২০১৮ সালের একটি গবেষণায় দেখা যায়, ৬৬% জেলে ঋণ করেছেন কিন্তু ৩৪% ঋণ করতে চেষ্টা করেও পাননি। তাদের আয়ের প্রায় পুরোটাই তাদের মৌলিক চাহিদা পূরণ করতেই শেষ হয়ে যায়, যেমন খাদ্য, ঔষধ, কাপড়, শিক্ষা এবং বাড়িঘর মেরামত। তাদের আয় দিয়ে তাদের ব্যয় মেটানো সম্ভব হয় না। লক্ষণীয় যে, ৭৫% পরিবারের কোনো সঞ্চয় নাই। যারা কিছুটা সঞ্চয় করেছেন, তা এতই অপ্রতুল যে তা দিয়ে প্রয়োজন মিটবে না।
জেলে পল্লীর ঘরগুলো বেশিরভাগই কাঁচা। ৯০% ঘরই টিন, বাঁশ ও কাঠ দিয়ে তৈরি। ঘরগুলো ছোট ও ঠাসাঠাসি করে স্থাপন করা। এক বছরের পুরোনো ঘর যেমন আছে, তেমনি ৫০ বছর বয়সী ঘরও দেখা যায়। উপকূলের পরিবেশ বিবেচনায় ঘরগুলো নিরাপদ নয় এবং ঝড় বা জলোচ্ছ্বাসে টিকে থাকার মতো নয়। জরিপ এলাকায় ৯৫% জেলেকে দেখা যায় নিবন্ধিত জমিতে অন্তত একটি নিজের ঘর আছে। পরিবারের সদস্য সংখ্যা অনুপাতে ঘরের জায়গা যথেষ্ট নয় এবং ঘর প্রতি বছরই মেরামত করতে হয়।
জেলেরা আত্মীয় স্বজনদের কাছাকাছিই বাস করে। তবে, সবার আত্মীয়ই একই গ্রামে বাস করে এমন নয়। জরিপের সময় দেখা যায়, তাদের আত্মীয়দের এক-তৃতীয়াংশ একই ইউনিয়নে বাস করে এবং বাকীরা অন্য ইউনিয়নে এমনকি অন্য উপজেলায় বাস করে। আত্মীয় কাছে থাকুক বা দূরে, সবারই মত হচ্ছে আত্মীয় থাকা সহায়ক। তবে, সবাই সাহায্য করার ক্ষমতা রাখে এমন নয়। তাদের বেশিরভাগ আত্মীয়ই দরিদ্র। তারা কেউ নৌকা, ট্রলার বা আড়তের মালিক নয়। যারা ধনী তাদের অর্ধেকের মধ্যে সাহায্য করার মনোভাব আছে। বাকি অর্ধেক গরিব আত্মীয় স্বজনকে এড়িয়ে চলে। গ্রামের মধ্যে তাদের ওঠাবসা কম। ধর্মীয় উৎসব ছাড়া তারা নিয়মিত আত্মীয়দের সাথে দেখা করেন না। জেলেদের গ্রামে নিজেদের মধ্য থেকে নেতৃত্ব নির্বাচিত হয় প্রথা অনুযায়ী নেতৃত্বের সহজাত গুণ দেখে অথবা ধনী ব্যক্তি দেখে।
জেলে গ্রামে পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও কাজ করেন। রান্না ও বাচ্চা দেখাশোনা ছাড়াও অনেক অর্থনৈতিক ও উৎপাদনশীল কাজে নারীদের যুক্ত থাকতে দেখা যায়। যেসব কাজে নারীরা বেশি যুক্ত থাকেন তার মধ্যে আছে চিংড়ির পোনা সংগ্রহ, শুটকি বা চিংড়ি প্রক্রিয়াজাতকরণ, জাল বোনা বা রিপু করা ইত্যাদি। এর পাশাপাশি অনেক নারীকে দেখা যায় বিভিন্ন মৌসুমে ঘরের পাশে সবজি বা ফসল ফলানো, গরু-ছাগল বা মুরগী পালন এবং সেলাইয়ের কাজে যুক্ত।
জেলে গ্রামে শিক্ষিত পরিবার প্রায় দেখাই যায় না। কিছু গ্রামে প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকলেও মাধ্যমিক বা কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র দেখা যায় না। বেশিরভাগই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। কিছু মাদ্রাসাও আছে। স্কুলগুলোর অবস্থানও দূরে। বেশিরভাগ শিক্ষার্থীকে অন্তত এক কিলোমিটার হাঁটতে হয় স্কুলে যাবার জন্য। স্কুলগুলো ছেলে মেয়ে উভয়ের জন্যই উপযোগী। সীমিত সুবিধা নিয়ে স্কুলগুলো বেশিরভাই পাকা ঘর বা টিনসেড। জেলে পল্লীর আশেপাশের স্কুলগুলো বেশিরভাগই পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত। ৭০% মেয়ের পড়াশোনার সময় গড়ে ৫ বছর এবং তাদের স্কুল থেকে ঝরে পড়া খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। স্কুল ছেড়ে দেবার প্রধান কারণ দারিদ্র। জেলে পল্লীর শিশুরা যথাযথ শিক্ষা পায়না কারণ তাদের অভিভাবক নিরক্ষর এবং স্কুলের অতিরিক্ত প্রাইভেট শিক্ষকের জন্য ব্যয় করার সামর্থ তাদের নাই। প্রতিটি গ্রামেই মাদ্রাসা রয়েছে, তবে তা খুব একটা জনপ্রিয় নয়। বিনামূল্যের মাদ্রাসায় ধর্মীয় শিক্ষার চেয়ে শিক্ষার্থীদের কাছে সরকারি স্কুলে যাওয়া বেশি আকর্ষণীয়, কারণ সেখানে আর্থিক সহায়তা পাওয়া যায়।
স্বাস্থ্যসেবার জন্য জেলেরা তিন ধরনের সেবার উপর নির্ভর করেন। স্থানীয় ফার্মেসি, সরকারি কমিউনিটি ক্লিনিক, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এবং প্রাইভেট হাসপাতাল বা ক্লিনিক। খরচ বাঁচাতে তারা স্থানীয় ফার্মেসির উপরই নির্ভর করেন, যেখানে কোনো ডাক্তার বা প্রশিক্ষিত ফার্মাসিস্ট নাই। কমিউনিটি ক্লিনিকে খুব সীমিত কিছু সেবা পাওয়া যায় এবং বেশিরভাগ সময়ই কোনো ডাক্তার থাকেন না।
২.৭ জেলে সম্প্রদায়ের মাঝে প্রতিষ্ঠান ও তাদের কর্মকা-
জেলে সম্প্রদায়ের ব্যবস্থাপনার জন্য বিভিন্ন সেবা ও নির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে ১৯টি বিভাগ ও ১২টি মন্ত্রণালয় যুক্ত। নিচের সারণীতে তাদের লক্ষ্য ও কর্মকা- বিস্তারিত দেয়া হল।
মন্ত্রণালয় বিভাগ লক্ষ্য জেলে সম্প্রদায় সংক্রান্ত কর্মকা-
প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বাংলাদেশ নেভি বঙ্গোপসাগরের নিরাপত্তা
অনুপ্রবেশ বন্ধ ও মনিটর করা
সমুদ্রে আইন শৃঙ্খলা বজায় রাখা ১০ বর্গ কি.মি. এলাকার ২১ টি জোনে টহল দেয়া।
উপকূল থেকে এক কি.মি. বাদে বাকিটা নেভি টহল দিয়ে থাকে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয় কোস্ট গার্ড আইন শৃঙ্খলা বজায় রাখা, পাচার প্রতিরোধ, অবৈধ মাছ ধরা ও ডাকাতি বন্ধ করা
সমুদ্রের অভিভাবক মাছ ধরা ও জাল ব্যবহারে আইনের প্রয়োগ করা, নিরাপত্তা উপকরণ নিশ্চিত করা, লাইসেন্স চেক করা, নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়ন করা, দূষণ নিয়ন্ত্রণ করা, মানব পাচার, ডাকাতি ও অবৈধ পাচার বন্ধ করা
ডাকাতির অভিযোগ গ্রহন, জরুরি প্রয়োজনে সাড়া দেয়া
বাংলাদেশ পুলিশ আইন প্রয়োগ, সামাজিক শৃঙ্খলা বজায় রাখা, অপরাধ দমন, জনগণের নিরাপত্তা বিধান, ডাকাতি, সমুদের প্রাণহানী, মারামারি ইত্যাদির মামলা গ্রহনের কর্তৃপক্ষ,
র‌্যাপিড একশন ব্যাটেলিয়ান (র‌্যাব) অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে আইন শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা বিশেষ করে বন্দরে ডাকাতি ও পাচার নিয়ন্ত্রণ
ইলিশ শিকারে নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়নে টহল ও নজরদারি
বাংলাদেশ নৌ পুলিশ নদী ও জলপথে একটি নিরাপদ পরিবেশ স্থাপন করা
দুর্ঘটনা প্রতিরোধে জলযান নিয়ন্ত্রণ নদী ও জলপথে মাছের অভয়ারণ্য, প্রজনন ক্ষেত্র, মা মাছ ইত্যাদির জন্য পরিবেশ সুরক্ষা
ডাকাতি, পাচার, কিডন্যাপ ইত্যাদির মতো অপরাধ দমন
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় উপজেলা নির্বাহি কর্মকর্তা উপজেলায় আইন ও নীতির প্রয়োগ করা এবং উপজেলায় সকল সরকারি এজেন্সির মধ্যে সমন্বয় করা ম্যাজিস্ট্রেটের ভূমিকা পালন, সকল এজেন্সির মধ্যে সমন্বয় ও তত্ত্বাবধান
জরুরি পরিস্থিতিতে ভুক্তভোগীর জন্য বিশেষ বরাদ্দ
মৎস্য ও পশুসম্পদ মন্ত্রণালয় উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা সামগ্রিক মৎস্য উন্নয়ন
অভ্যন্তরীন মাছ শিকার
অভ্যন্তরীন মাছ চাষ
সামুদ্রিক মাছ আহরণ জেলে পরিচয়পত্র বিতরণ
জেলেদের কল্যান
মৎস্য উৎপাদন ও রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ
সমুদ্র পরিচালক সামুদ্রিক মৎস্য উৎপাদন ও সুরক্ষা
মৎস্য আহরণ মনিটরিং নেীকার লাইসেন্স
মৎস্য আহরণ অনুমোদন
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট মৎস্য সম্পদের ব্যবহার ও কার্যকর উৎপাদনের কৌশল উদ্ভাবন মাছ চাষ, সামুদ্রিক সম্পদ ব্যবহার ইত্যাদি বিষয়ে গবেষণা
বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন করপোরেশন মৎস্য আহরণ, অবতরণ, প্রক্রিয়াজাত, সংরক্ষণ, বিক্রয়, মান নিয়ন্ত্রণ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত ও সহায়তা করা মৎস্য অবতরণ ঘাটের উন্নয়ন, বরফ সরবরাহ, প্রক্রিয়াজাত করন
কর আদায়
মৎস্য বাণিজ্যের লাইসেন্স প্রদান
স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় ইউনিয়ন পরিষদ ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্রে স্বাস্থ্য সেবা ও স্যানিটেশন নিশ্চিত করা
দ্বন্দ্ব নিরসন
জন্ম, মৃত্যু, বিবাহ এবং কৃষি ও মৎস্য বিষয়ক নিবন্ধন
ঋণ সহায়তা
গ্রামীন দরিদ্রদের সহায়তা নাগরিকত্ব সনদ, মৃত্যু সনদ প্রদান
অসহায় জনগোষ্ঠীর তালিকা তৈরি
ভিজিএফ বাস্তবায়ন
দ্বন্দ্ব নিরসন
পৌরসভা জন্ম, মৃত্যু, বিবাহ নিবন্ধন
দারিদ্র নিরসন, শিক্ষা, স্যানিটেশন ও উন্নয়ন প্রকল্প
ঋণ সহায়তা নাগরিকত্ব সনদ, মৃত্যু সনদ প্রদান
অসহায় জনগোষ্ঠীর তালিকা তৈরি ও ত্রাণ বিতরণ
দারিদ্র বিমোচন কর্মসূচি বাস্তবায়ন
ভিজিএফ বাস্তবায়ন
দ্বন্দ্ব নিরসন
সমাজ কল্যান মন্ত্রণালয় সমাজ কল্যান কর্মকর্তা সমাজ কল্যান, সুরক্ষা, দরিদ্র ও অসহায় গ্রুপের উন্নয়ন ও ক্ষমতায়ন সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি ও নগদ সহায়তা
অসহায় মানুষের জন্য জরুরি পরিস্থিতিতে বিশেষ বরাদ্দ
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় প্রকল্প বাস্তবায়ন কার্যালয় প্রকল্প ও ত্রাণ কার্যক্রম বাস্তবায়ন (বিশেষ করে দুর্যোগ ঝুঁকি মোকাবেলায়) ভিজিএফ তত্ত্বাবধান করা
কল্যানমূলক ও ত্রাণকাজ তত্ত্বাবধান
নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় মারকেন্টাইল মেরিন বিভাগ সোলাস কনভেনশন (সমুদ্রে জীবনের নিরাপত্তা) বাস্তবায়ন। এর মাধ্যমে জাহাজ নির্মাণ, সরঞ্জাম ও পরিচালনায় ন্যূনতম আন্তর্জাতিক মানদন্ড অনুসরণ করা হয়।
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সনদের শর্ত পূরণ নৌযানের লাইসেন্স
জেটি ও ঘাট উন্নয়ন
সমুদ্রগামী সকল বাংলাদেশি নৌযান জরিপ
ব্লু ইকোনমি সংক্রান্ত প্রকল্প বাস্তবায়ন
সমুদ্র দূষণ নিয়ন্ত্রণ
ক্রিড়া ও যুব মন্ত্রণালয় যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর বেকারত্ব হ্রাস (১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সী) জীবিকা সহায়তার জন্য দক্ষতা উন্নয়ন
শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় শ্রম অধিদপ্তর শ্রমিক কল্যান উদ্বুদ্ধ করা
ট্রেড ইউনিয়ন লাইসেন্স ট্রেড ইউনিয়নের লাইসেন্স প্রদান ও ট্রেড ইউনিয়ন উদ্বুদ্ধ করা
পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় পানি উন্নয়ন বোর্ড উপকূলীয় বেড়িবাঁধ উন্নয়ন ও রক্ষণাবেক্ষণ
উপকূলীয় খাল খনন ও জলোচ্ছ্বাস থেকে সুরক্ষা অনেক জেলে বেড়িবাঁধে বাস করেন এবং তারা বাঁধ রক্ষণাবেক্ষণে যুক্ত
পানি উন্নয়ন বোর্ডের জমিতে অনেক জেলে বসবাস করেন
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় পরিবেশ অধিদপ্তর পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত আইনী সুরক্ষা প্রণয়ন
বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন ২০১২ বাস্তবায়ন
সামুদ্রিক সম্পদ ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক চুক্তি বাস্তবায়ন অবৈধ মৎস্য আহরণ ও সমুদ্রে অবৈধ বাণিজ্যিক কার্যক্রম, বা কোনো অননুমোদিত কার্যক্রম প্রতিরোধ করা
সামুদ্রিক প্রাণীর দীর্ঘমেয়াদি সুরক্ষা নিশ্চিত করা
সমুদ্রে সংরক্ষিত এলাকা ঘোষণা, বঙ্গোপসাগরে সাবমেরিন অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তত্ত্বাবধান

রাষ্ট্রীয় অধিকার রক্ষাকারী প্রতিষ্ঠানসমূহ দুইটি ভিন্ন লক্ষ্য থেকে সামুদ্রিক মৎস্য আহরণের সাথে যুক্ত, একটি হচ্ছে সামুদ্রিক বাস্তুসংস্থান সুরক্ষা ও অন্যটি হচ্ছে জেলেদের উন্নয়ন। প্রতিটি বিভাগ ও প্রতিষ্ঠানেরই তাদের নিজ লক্ষ্যের প্রতি দৃষ্টিনিবদ্ধ। কিছু প্রতিষ্ঠান যেমন মৎস্য অধিদপ্তর, মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট ইত্যাদি সামুদ্রিক সম্পদ সুরক্ষা ও সংরক্ষণ বিষয়ে কাজ করছে তেমনি সমাজ কল্যান অধিদপ্তর, স্থানীয় সরকার ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানগুলো সমাজের জন্য সমুদ্রগামী জেলেদের জীবিকা ও উন্নয়ন নিয়ে কাজ করছে।
৩. নারী ও শিশু অধিকার
ক্রমাগত মৌলিক চাহিদার জন্য সংগ্রাম করতে হয় বলে, জেলে পল্লীতে নারী ও শিশুরাই সবচেয়ে অসহায়। কাজ করার সামর্থ ও ইচ্ছা থাকলেও নারীদের তা করার মতো কোনো সুযোগ সুবিধা নাই। আপাতভাবে, নারীরা একটা যৌক্তিক পারিশ্রমিকের কাজ পাবার জন্যই সংগ্রামরত। জেলে জনগোষ্ঠীর নারীদের জন্য কাজের সুযোগ সৃষ্টি বা কর্মসংস্থানের জন্য কোনো প্রতিষ্ঠান না থাকায় অনানুষ্ঠানিকভাবে কাজ করা, মাছ, চাউল বা সামান্য টাকার বিনিময়ে কাজ করা ছাড়া নারীদের আর কোনো পথ নাই। এমনকি চাহিদার তুলনায় নারী শ্রমিক বেশি থাকায় ও তার ফলে কাজ করার জন্য নারীদের মধ্যে প্রতিযোগিতা থাকায় খুবই অন্যায্য পারিশ্রমিকে তাদের কাজ করতে হচ্ছে। জরিপে দেখা যায় ৮৩% নারীর কোনো কর্মসংস্থান নেই এবং ৯১% নারী পুরুষের তুলনায় কম বেতন পাবার বিষয়টা মেনে নিয়েছেন। নারীদের সমুদ্রে গিয়ে মাছ ধরার অনুমতি নেই। কাজের ধরন, নৌকার নকশা ইত্যাদির কারণে নারীদের পক্ষে সামুদ্রিক সম্পদে সরাসরি অংশগ্রহন করা সম্ভব নয়। তবে, এটিই একমাত্র কারণ নয়। আরো গভীর কারণ রয়েছে মানুষের বিশ্বাসের মধ্যে যে, নারীরা সব কাজের উপযুক্ত নয়, তাদের জন্মই হয়েছে সংসার ধর্ম পালন করার জন্য।
নারীরা সাধারণত ঘরে এবং ঘরের সংলগ্ন জায়গায়ই কাজ করেন। নারীর কাজের মধ্যে রয়েছে কাঁথা সেলাই, জাল রিপু করা, হাঁস মুরগী, গরু-ছাগল পালন, মাছ ধোয়া, গৃহস্থালি কাজ এবং কৃষিকাজে সহায়তা। একটি কাঁথা সেলাই করতে অন্তত ১০ দিন সময় লাগে এবং এর জন্য ২০০ থেকে ২৫০ টাকা পাওয়া যায়। এসব সেলাইয়ের কাজ অনেক সময় চুক্তিভিত্তিক থাকে এবং কাঁথা প্রতি ৪০০/ ৫০০ টাকা ধার্য করা থাকে। তবে এসব কাজ নিয়মিত থাকে না। জাল রিপু করার কাজ সাধারণত দৈনিক ভিত্তিক থাকে। সকাল দশটা থেকে রাত পর্যন্ত কাজ করলে দৈনিক ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা পাওয়া যায়। সারা মাস জাল রিপু করার কাজ করে ২ থেকে ৩ হাজার টাকা পাওয়া যায়, কারণ পুরো জেলে পল্লীই দারিদ্রপীড়িত এবং সাধারণ মজুরি অত্যন্ত কম। নিষেধাজ্ঞা চলাকালিন সময়ে নারীরা সপ্তাহে সাত দিনই জাল রিপুর কাজ করেন এবং তখন তারা হয়ত ৩ হাজারের বেশি আয় করতে পারেন। তবে, ইদানিং মেশিনে তৈরি জাল বাজারে সহজলভ্য হওয়ায় নারীদের অন্যতম প্রধান এই আয় অনেক কমে গেছে। বিশেষ করে বিধবা নারীদের জন্য বেঁচে থাকার লড়াই অনেক কঠিন।
কৃষিতে, বিশেষ করে মহেশখালিতে, নারীরা জমি লিজ নিয়ে চাষাবাদ করেন, স্থানীয় ভাষায় একে বলে লাগোতি। লাগোতি ঠিক বর্গাচাষের মতো ফসল ভাগ পদ্ধতির নয়। এক্ষেত্রে একটা মৌসুমের জন্য জমি ভাড়া নেয়া হয়। নারীরা দল বেঁধে ভাগাভাগি করে কাজ করেন, কারণ তাদের সংসারের কাজ ও বাচ্চা দেখাশোনার কাজও করতে হয়। লাগোতি পদ্ধতিতে নারীরা জমি ভাড়া, বীজ ক্রয় ও অন্যান্য উপকরণ কিনতে বিনিয়োগ করার মাধ্যমে মূলত সবজি উৎপাদন করেন। তবে, সবজি বিক্রি করে যথেষ্ট টাকা না পেলেও তাদের জমির ভাড়া পরিশোধ করতে হয়। এজন্য তারা প্রায়ই উচ্চ সুদে টাকা ধার করেন। বড় মহেশখালিতে দেখা যায় প্রতি দশ হাজার টাকা ধার করতে প্রতি মাসে দুই হাজার টাকা করে সুদ দিতে হয়। নারীদের অনেকে খালে মাছ বা কাঁকড়া ধরেন এবং সেগুলো বিক্রি করে দৈনিক ২০ থেকে ৫০ টাকা আয় করেন। ১২-১৩ বছর বয়সী শিশুরা নদীতে মাছ ধরার কাজ করে, তবে বয়সে ছোট বলে তাদের অনেক কম টাকা মজুরি দেয়া হয়।

তৃতীয় অধ্যায়
বাংলাদেশের কৃষিতে নারী: গ্রন্থ পর্যালোচনা

১. বাংলাদেশের কৃষিতে নারী
বাংলাদেশের কৃষিতে নারীদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে । উৎপাদনের প্রেক্ষিতে বর্তমানে ৪৩% গ্রামীন নারী তাদের গৃহস্থালি কাজের পাশাপাশি কৃষি অথবা জলকৃষি বা মৎস্য সংক্রান্ত কর্মকান্ডে সময় দিয়ে থাকেন । বাংলাদেশের কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থায় শ্রমই প্রধান চাহিদা এবং পরিবারের সদস্য, বিশেষ করে নারীর শ্রম এখানে যুক্ত করে কৃষকেরা তাদের উৎপাদন ব্যয় সাশ্রয় করে থাকেন । একটি গবেষণায় দেখানো হয়েছে যে, উক্ত গবেষণা এলাকায় মৎস্য চাষে নারীরা যুক্ত হওয়ার ফলে উৎপাদন ১০ থেকে ২০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে ।
এতদসত্ত্বেও, নারীর অবদানের স্বীকৃতি খুবই অপ্রতুল এবং জাতীয় পরিসংখ্যানে তা তেমন প্রতিফলিত নয়। সাধারণভাবেই দেখা যায়, বাংলাদেশে জলকৃষিতে সুনির্দিষ্ট কিছু কাজে নারীর অংশগ্রহনটাই মুখ্য, যদিও তা প্রায়ই অস্বীকৃত (এবং প্রায়শ মজুরিবিহীন)। কাজগুলো হচ্ছে, পুকুর সংস্কার, মাছের খাদ্য তৈরি, খাওয়ানো, পুকুর দেখাশোনা ও ব্যবস্থাপনা, সার দেয়া, চুন দেয়া, পরিবারের খাবার জন্য মাছ ধরা। এ ছাড়াও উৎপাদিত মাছ বাজারে নেবার আগে মাছ বাছা, পরিষ্কার করা বা বাছাই করা ইত্যাদি কাজও নারীরাই করে থাকেন (উধং ধহফ কযধহ ১৯৯৬; অযসবফ ২০০৯; ঝযরৎধলবব বঃ ধষ. ২০১০)। বাজারের জন্য মাছ ধরা, বাজারজাত করা, মাছের খাদ্য বা সার কেনা ইত্যাদি কাজগুলো পুরুষেরা করে থাকেন (ঝযরৎধলবব বঃ ধষ. ২০১০)। জলকৃষিতে নারীর ক্রমবর্ধমান অংশগ্রহনের মূল বাধা হচ্ছে নারীর অতিরিক্ত কাজের ভার এবং সামগ্রিকভাবে ঘরে বাইরে কাজের লিঙ্গভিত্তিক বন্টনে অসমতা (ঔধযধহ বঃ ধষ. ২০১০; ঝযরৎধলবব বঃ ধষ. ২০১০; গড়ৎমধহ বঃ ধষ., ২০১৬)।
মৎস্য উৎপাদনে নারীর অংশগ্রহন স্থানভেদে, প্রযুক্তির ব্যবহার ও সাংস্কৃতিক কারণে ভিন্ন হয়ে থাকে। উদাহরণ স্বরূপ, একটি হিন্দু পরিবারে মৎস্য চাষে নারীর সক্রিয় অংশগ্রহন দেখা গেলেও একটি রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারে এই অংশগ্রহনের মাত্রা কম । মৎস্য চাষে নারীর অংশগ্রহন পরিবারের স্বচ্ছলতার ধরনের উপরও নির্ভর করে। ধনী বা সচ্ছল পরিবারের ক্ষেত্রে দেখা যায় নারীর কাজগুলো মজুর রেখে করানো হয় । মাছের খামারের ভ্যালু চেইনের বিভিন্ন স্তরে নারীর অংশগ্রহন বেশ সীমিত। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে করা একটি ভ্যালু চেইন গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, ব্যবসা বা খুচরা বিক্রির ক্ষেত্রে ০-১% হচ্ছে নারী । কিন্তু মৎস্য আহরণ সংক্রান্ত ভ্যালু চেইনে নারীর অংশগ্রহনের চিত্র আলাদা। শুটকি মাছ প্রক্রিয়াজাতকরণে দেখা যায় ৮০% শ্রমিকই নারী ও শিশু । আরেকটি উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, নিরাপদ ও শোভন কর্মপরিবেশ সংক্রান্ত আইনের প্রয়োগ মৎস্য খাতে প্রায় অনুপস্থিত। যা এখানে কর্মরত দরিদ্র নারী, শিশু ও পুরুষদের অবস্থার অবনতি ঘটাচ্ছে। প্রাইভেট চিংড়ি ঘের ও প্রক্রিয়াজাত কারখানায় ঝুঁকিপূর্ণ কর্মপরিবেশে তারা দিনে দীর্ঘ সময় কাজ করেন। কাজের চুক্তি যেমন অনিরাপদ, পারিশ্রমিকও খুব কম।
জিডব্লিউএপিবি এবং ইউল্যাব-সিএসডি পরিচালিত গবেষণায় দেকা যায়, বাংলাদেশে মৎস্য বা পানির খামারে নারীর অবদান অদৃশ্যমান থাকার মূল কারণ জনসমক্ষে নারীর কাজে সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও পরিবারের পুরুষ সদস্যদের বাধা। পুরুষ সদস্যরা নারীদেরকে ব্যবসা, বাজার এবং অর্থ সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহনে যুক্ত করেন না। বিশ্বব্যাংকের একটি স্টাডিতে দেখানো হয়েছে, ঘরের সিদ্ধান্ত গ্রহন প্রক্রিয়ায় নারীর প্রবেশাধিকার সীমিত, পরিবারের সম্পদে (স্থাবর ও আর্থিক সম্পত্তি) নারীর প্রবেশাধিকার ও নিয়ন্ত্রন সীমিত, ব্যক্তিগত সম্পদের পরিমাণ কম, গৃহস্থালি কাজের প্রচ- চাপ, যাতায়াত নিয়ন্ত্রিত এবং জ্ঞান ও দক্ষতাও অপর্যাপ্ত, যা নারীকে অসহায়ত্বের দিকে ধাবিত করে (ঝবনংঃধফ ধহফ ঈড়যবহ, ২০০০)।
২. বাংলাদেশে বর্তমান নীতি ও আইনী কাঠামো
নারী ও শিশু সংক্রান্ত নীতির উন্নয়ন ও বাস্তবায়ন, নারীর ক্ষমতায়ন, নারী নির্যাতন প্রতিরোধ, নারীর আর্থ-সামাজিক, মানসিক ও শারীরিক উন্নয়ন ইত্যাদি নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদানের কর্তৃত্ব রয়েছে বাংলাদেশের সংবিধানের। নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় সকল ধরনের বৈষম্য ও নির্যাতন প্রতিরোধ করার লক্ষ্যে পরিবারিক নির্যাতন (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন ২০১০ এর অধীনে পরিবারিক নির্যাতন (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) নীতিমালা ২০১৩ প্রণয়ন করে। নারী ও শিশুদের সকল ধরনের উন্নয়নের লক্ষ্যে সরকার প্রণয়ন করেছে জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিমালা ২০১১, জাতীয় শিশু নীতিমালা ২০১১, প্রাক-শৈশব যতœ ও উন্নয়ন নীতিমালা ২০১৩, ডিএনএ অ্যাক্ট ২০১৪ ও বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ আইন ২০১৭।
জেন্ডার সমতা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক কনভেনশনে স্বাক্ষর করেছে, যেমন বেইজিং প্লাটফরম ফর একশন (বিপিএফএ), সিডো সনদ এবং এসডিজি ইত্যাদি। ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশ সিডো সনদে স্বাক্ষর করার সময় এর ধারা ২, ১৩.১ [এ], ১৬.১ [সি] এবং [এফ] ধারাসমূহের ব্যাপারে আপত্তি রেখে দেয় । কারণ এই ধারাগুলোকে ইসলামিক শরীয়া আইন সমর্থন করে না। তবে, ইতিমধ্যে কয়েকটি নারী অধিকার ভিত্তিক সংগঠন ও নাগরিক সমাজের অধিপরামর্শের ভিত্তিতে সরকার ধারা ১৩.১ [এ] এবং ধারা ১৬.১ [এফ] বিষয়ে আপত্তি তুলে নেয় (অডঙজঈ, ২০০০)।
পাশাপাশি, বাংলাদেশে জলকৃষির কাজে জেন্ডার সমতা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বেশ কিছু নীতিমালা রয়েছে। জাতীয় কৃষি সম্প্রসারণ নীতিমালা ২০১২ জেন্ডার সমতা ব্যাপারে ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহনের কথা বলেছে। পুরাতন কৃষি সম্প্রসারণ নীতিমালা ১৯৯৬ কে সংস্কার করে সংঘটিত চাহিদা নিরূপণের সুপারিশের ভিত্তিতে সেখানে জেন্ডার মূলধারাকরণ যুক্ত করা হয়েছে (কধৎরস বঃ ধষ., ২০০৯)। সেই তুলনায় জাতীয় মৎস্য নীতি ১৯৯৮ তেমন কোনো সংস্কার করা হয়নি, বিশেষ করে জেন্ডার বিষয়টি সম্পৃক্ত করার ক্ষেত্রে। এখানে শুধুমাত্র বলা হয়েছে, “নারীদের মৎস্য চাষে উৎসাহিত করা হবে এবং সে অনুযায়ী প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দেয়া হবে” (গরহরংঃৎু ড়ভ ঋরংযবৎরবং ধহফ খরাবংঃড়পশ ইধহমষধফবংয, ১৯৯৮)।
গ্রামীন ও কৃষি খাতের অন্য কিছু নীতিমালাতেও নারীর অবস্থান উন্নয়নের সুযোগ রাখা হয়েছে। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ নীতিমালা হচ্ছে, জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশল ২০১৫, বাংলাদেশ দারিদ্র বিমোচন কৌশলপত্র, মার্চ ২০১৩, সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা ২০১৬-২০২০, বাংলাদেশ শ্রম আইন (সংশোধিত) ২০১৩, জাতীয় কৃষি নীতি ২০১৮, জাতীয় পশুসম্পদ উন্নয়ন নীতিমালা ২০১৭ এবং জাতীয় শিল্প নীতিমালা ২০১৬। সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় নারীর অগ্রসরতা উন্নয়নের লক্ষ্য হিসেবে নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য সমান কর্মসংস্থান ও মৌলিক মানবাধিকার নিশ্চিত করার মাধ্যমে একটি সমতাপূর্ণ সমাজ বিনির্মাণের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এটি সরকারের রূপকল্প ২০২১ এর লক্ষ্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ যেখানে জেন্ডার সমতার কথা বলা হয়েছে।

পঞ্চম অধ্যায়
স্টাডির ফলাফল

১. জেলে পরিবারের নারী সদস্যদের মৌলিক চিত্র
এই স্টাডিতে মোট ১,২০০ জনের সাক্ষাৎকার গ্রহন করা হয়েছে, যাদের বেশিরভাগের বয়স ২৫ থেকে ৩৪ এর মধ্যে। ৫৬ থেকে ৮৫ বয়স্ক নারীরাও এই তথ্য সংগ্রহ প্রক্রিয়ায় অংশ নিয়েছেন। ৯৮% উত্তর ছিলেন বিবাহিত, ১% বিধবা এবং ১% এর কম অবিবাহিত।
২. নারী সদস্যদের আর্থ সামাজিক চিত্র
২.১ জেলে পরিবারে নারী সদস্যদের মূল পেশা
জরিপের উত্তরদাতাদের মধ্যে ৯৭.১১% হচ্ছেন গৃহিনী। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১% নারী হচ্ছেন পেশাগতভাবে জেলে, তারা সরাসরি মাছ চাষ বা মাছ ধরার সাথে যুক্ত। অন্যান্য পেশা তেমন একটা উল্লেখযোগ্য নয়। এই তথ্য থেকে বোঝা যায়, উপকূলীয় জেলে পরিবারের সিংহভাগ নারী আয় সংক্রান্ত কর্মকা-ে খুব কম সম্পৃক্ত।

২.২ আয়ের মাত্রা
জরিপে দেখা যায় বেশিরভাগ পরিবারের বার্ষিক আয় ২০ হাজার টাকা থেকে এ লক্ষ টাকার মধ্যে। অর্থাৎ, পরিবারের মাসিক আয় দাঁড়ায় সর্বনি¤œ ১,৬০০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৮,০০০ টাকা। একটিমাত্র পরিবার পাওয়া যায় যাদের বার্ষিক আয় ১ লক্ষ ৮০ হাজার টাকা। ১১% পরিবার হত দরিদ্র যাদের দৈনিক আয় ১.৯৭ ডলারের চেয়েও কম, এবং তাদের বার্ষিক আয় মাত্র ১৩,০০০ টাকা। ৬৭% পরিবার দরিদ্র যাদের গড় মাসিক আয় ১,৬০০ থেকে ৮,০০০ টাকা। সংগৃহিত তথ্যে দেখা যায়, পরিবারগুলো বিভিন্ন উৎস থেকে আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক ঋণ বা ধার গ্রহন করে থাকেন। ৬৮% উত্তরদাতা বিভিন্ন উৎস থেকে ঋণ গ্রহন করেছেন। ঋণগ্রহিতাদের মধ্যে ৬২% ঋণ করেছেন এনজিও থেকে। ঋণের অন্যান্য উৎস হচ্ছে আত্মীয় ও স্থানীয় মহাজন।
২.৩ পরিবারের গঠন
৪৯% উত্তরদাতার পরিবারের সদস্য সংখ্যা ১ থেকে ৪ জন, ৪৮% উত্তরদাতার পরিবারের সদস্য সংখ্যা ৫ থেকে ৮ জন এবং ২% এর ৯ থেকে ১০ জন।
২.৪ উপকূলীয় মৎস্য খামার বা মৎস্য আহরণে নারীর অংশগ্রহনের ধরন
স্টাডিতে দেখা যায়, বেশিরভাগ নারী মৎস্য খামার বা মৎস্য আহরণের পশ্চাতে থেকে সহায়তার কাজগুলো করেন, এবং এভাবেই জেলে নারীরা পশ্চাৎপদ অবস্থানে। যেসব কাজ নারীরা করে থাকেন:
খাত নারীর অংশগ্রহনের ক্ষেত্র
প্রক্রিয়াজাতকরণ মাছ বাছাইয়ের জন্য ওজন করা, বাছাই করা ও মাছ কাটা।
উৎপাদন খাঁচা তৈরি, জাল বোনা, মাছ সংগ্রহ
চিংড়ি ঘের প্রস্তুতি (বাগেরহাট) মাটি বহন করা, বাঁধ দেয়া, চুন দেয়া, বাঁধ মেরামত, খাল কাটা
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নারীর কাজ অদৃশ্য এবং অস্বীকৃত।
২.৫ জেলে পরিবারে নারীর শিক্ষা
উপকূলীয় জেলে পরিবারগুলোতে জরিপে দেখা যায়, সারা দেশের নারী শিক্ষার চিত্রের তুলনায় জেলে নারীরা পরিষ্কারভাবে অনেক পিছিয়ে। বাগেরহাটের সাধারণ পরিবারের মেয়ে শিশুদের স্কুলে উপস্থিতির হার ৯২%, ভোলায় ৯৫% এবং কক্সবাজারে ৯৩%। কিন্তু জেলে পরিবারগুলোতে মাত্র ৬০% নারী সদস্য পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষা সম্পন্ন করেছেন। মাত্র ২৬% উত্তরদাতা ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত বিভিন্ন শ্রেণীতে পড়েছেন। ১,২০০ উত্তরদাতার মধ্যে মাত্র ১০ জন এসএসসি পাশ করে কলেজে পা রেখেছিলেন।
অন্যদিকে, উক্ত জেলাগুলোতে সার্বিকভাবে মেয়ে শিশু শিক্ষার হার বেশ ভালো অবস্থানে রয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মেয়েরা ছেলেদের চেয়েও এগিয়ে আছে। কিছু সূচকে দেখা যায়, উপকূলীয় জেলে পরিবারের মেয়ে শিশু ও নারীরা অন্যান্য জনগোষ্ঠীর তুলনায় অনেক পিছিয়ে।
২.৬ আয়বর্ধনমূলক কাজে সম্পৃক্ততা
এটাই প্রত্যাশিত যে, উত্তরদাতা পরিবারগুলোর আয়ের প্রধান উৎস মৎস্য, প্রাপ্ত তথ্যও তা প্রকাশ করে। ৯৯% পরিবারের আয়ের প্রধান উৎস এটাই। জেলে পরিবারের নারী সদস্যরা পুরোপুরি মৎস্য জীবিকার সঙ্গে জড়িত নন। ৭০% নারী সদস্য পরিবারে অবদান রাখার জন্য বিভিন্ন কর্মকান্ডে জড়িত। যেমন, ৫৪% নারী মাছ শুটকি করার কাজে যুক্ত, ১১% নারী জাল বোনেন। পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থায় নারীর ক্ষমতায়নের প্রধান বাধা হচ্ছে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড তথা আয়ে সঙ্গে নারীর কম সম্পৃক্ততার ফলে নিজেদের অর্থনৈতিকভাবে তুলনামূলক কম আত্মনির্ভরশীল হওয়া। উপকূলীয় জেলে পরিবারগুলোতেও একই বাস্তবতা বিদ্যমান। এই স্টাডিতে দেখা যায়, সমাজে ও পরিবারে উভয় ক্ষেত্রেই সিদ্ধান্ত গ্রহন প্রক্রিয়ায় নারীর অংশগ্রহন কম। পরবর্তী অনুচ্ছেদে এ বিষয়ক তথ্য ও উপাত্ত উপস্থাপন করা হল।
এই স্টাডিতে ঘরের তুলনায় বাইরে পুরুষের পাশাপাশি নারীর বৃত্তিমূলক কাজে কম অংশগ্রহনের কারণ চিহ্নিত করার চেষ্টা করা হয়েছে। ৫৫% উত্তরদাতা ঘরে কোনো না কোনো ধরনের আয়বৃদ্ধিমূলক কাজে যুক্ত, তবু তারা মনে করেন, বাইরে পুরুষের পাশাপাশি কাজ করা ‘খারাপ’। যদিও ৩০% মনে করেন এতে কোনো সমস্যা নাই। ১৫% নারী উত্তরদাতার কর্মক্ষেত্রে তাদের পুরুষ সহকর্মী দ্বারা মৌখিক নিপীড়নের শিকার হবার অভিজ্ঞতা আছে।
ঘরের বাইরে বৃত্তিমূলক কাজের সাথে যুক্ত প্রতিটি উত্তরদাতা মজুরি বৈষম্যের শিকার হয়েছেন। ১০০% উত্তরদাতা একই কাজের ক্ষেত্রে তাদের পুরুষ সহকর্মীর চেয়ে কম মজুরি পান। মজার ব্যাপার হচ্ছে, ২১% উত্তরদাতা কম মজুরিটা প্রচলিত চর্চা হিসেবে মেনে নিয়েছেন। ৩৯% উত্তরদাতার অভিজ্ঞতা হচ্ছে, তাদের পুরুষ সহকর্মীরা মনে করেন নারীর শ্রম সস্তা। ৪০% উত্তরদাতার মালিকেরা বলে থাকেন যে, তারা পুরুষের তুলনায় কম কাজ করেন তাই কম মজুরি পান।
উপকূলীয় জেলে পরিবারের নারী সদস্যদের বেশিরভাগ বৃত্তিমূলক কাজের জন্য উপযুক্ত কোনো প্রশিক্ষণ পান নি। মাত্র ৩৪% নারী একটি বা দুটি বৃত্তিমূলক কাজের উপর প্রশিক্ষণ লাভের সুযোগ পেয়েছেন।
২.৭ সিদ্ধান্ত গ্রহন প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহন
অর্ধেকের মতো উত্তরদাতা (৫৩%) মনে করেন তারা আংশিকভাবে পরিবারের সিদ্ধান্ত গ্রহন প্রক্রিয়ায় যুক্ত থাকেন এবং ৪২% বিশ্বাস করেন, তারা নিয়মিত পরিবারের সিদ্ধান্ত গ্রহন প্রক্রিয়ায় অংশ নেন। ৫% কখনই অংশগ্রহন করেন না।
তবে, অন্য তথ্যগুলো দিয়ে একটা ভিন্ন চিত্র ফুটে ওঠে। যদিও প্রায় অর্ধেক উত্তরদাতা মনে করেন, তারা আংশিকভাবে তাদের পরিবারের সিদ্ধান্ত গ্রহন প্রক্রিয়ায় অংশ নেন, কিন্তু যখন তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে তাদের অংশগ্রহনের মাত্রা পরীক্ষা করা হয়, তখন দেখা যায় সেটা আসলে অনেক কম। যেমন, ৩১% উত্তরদাতা পরিবারের সম্পদের ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহন প্রক্রিয়ায় অংশ নেন না, বিশেষ করে সম্পদ ক্রয় বা বিক্রয়ের ক্ষেত্রে। পরিবারের কোনো সদস্যের বিয়ের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহনে ৪২% উত্তরদাতা বলেন তারা অংশ নেন। পরিবারের ব্যয়ের ব্যাপারে কোনো কথা বলার সুযোগ পান না ৫৮% নারী।
উপকূলীয় প্রান্তিক সমাজ, যা মূলত আচরণের দিক থেকে পুরুষতান্ত্রিক, পরিবারের সিদ্ধান্ত গ্রহন প্রক্রিয়ায় নারীর অংশগ্রহন কাঙ্খিত মাত্রার থেকে অনেক দূরে অবস্থিত। সংগৃহীত তথ্য ও উপাত্ত এই মত সমর্থন করে। পাশের গ্রাফের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাব, পরিবারের সিদ্ধান্ত গ্রহন প্রক্রিয়ার তিনটি গুরুত্বপূর্ণ সূচকের সবগুলোতেই ‘না’ বড়।
প্রাপ্ত তথ্য থেকে দেখা যায়, বিভিন্ন সামাজিক কাঠামোতেও নারীদের অংশগ্রহন অনেক কম। ৮২% নারী স্থানীয় পর্যায়ে কোনো বিচার সালিশ বা গ্রাম আদালতে অংশগ্রহন করেন না। স্থানীয় কোনো প্রতিষ্ঠান যেমন বাজার বা স্কুলের কোনো কমিটিতে তাদের কেউ সদস্য নন। ৮২.৩৪% উত্তরদাতা ইউনিয়ন পরিষদ সম্পর্কে জানেন, কিন্তু মাত্র ২% কোনো সেবা বা অন্য কাজে নিজেই সরাসরি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের সাথে যোগাযোগ করেছেন। ৮৩% উত্তরদাতাকে কোনোদিন স্থানীয় সেবাদাতাগণ উন্নয়নমূলক কোনো কর্মকা-ের ব্যাপারে তাদের মতামত চান নি। মাত্র ১২% মনে করতে পারেন, তাদের কাছে এমন মতামত চাওয়া হয়েছে।
বেশিরভাগ উত্তরদাতাই (৬৫%) নিজেদের ইচ্ছায় কোনো প্রয়োজনে ঘরের বাইরে যেতে পারেন, তবে কিছু বিধিনিষেধ আছে। ৯৮% নারী যে কোনো সময় তাদের ইচ্ছামতো প্রতিবেশির বাড়ি যেতে পারেন। ৪২% উত্তরদাতা নিজের ইচ্ছায় তাদের আত্মীয়ের বাড়ি বেড়াতে যেতে পারেন, তবে সেক্ষেত্রে আত্মীয়ের বাড়ি দূরে হতে পারবে না। ৩৫% উত্তরদাতা এমনকি এমন দাবি করেন, প্রয়োজন মনে করলেও তারা চিকিৎসা সেবা পেতে পারেন না।
২.৮ নারীর প্রতি সহিংসতা
উপকূলীয় জেলে পরিবারের নারী সদস্যরা ঘরে এবং বাইরে নানা ধরনের সমস্যা ও চ্যালেঞ্জের মুখোমুখী হন। ৬২% উত্তরদাতা পৃথক পৃথক মাত্রায় নারীর প্রতি সহিংসতার শিকার। তাদের বেশিরভাগ (৭৪%) অনিরাপদ অনুভব করেন, যখন তাদের পরিবার প্রধান মাছ ধরার জন্য সমুদ্রে থাকেন। ৭৬% উত্তরদাতা কোনো না কোনো সময় প্রতিবেশি বা সমাজের নেতার কাছে নিপীড়নের ব্যাপারে নালিশ করেছেন। মাত্র ১৩% ক্ষেত্রে তারা সেসব অভিযোগের প্রেক্ষিতে বিচার পেয়েছেন। যে পরিবারে মেয়ে শিশু আছে, তারা পরিবার প্রধান বাড়ির বাইরে থাকলে সবচেয়ে বেশি অনিরাপদ অনুভব করেন।
২.৯ সমপর্যায়ে যোগাযোগ, নেটওয়ার্কিং
উত্তরদাতাদের মধ্যে নেটওয়ার্কিং সংক্রান্ত ধারণা প্রায় শূন্যের কোঠায়। নেটওয়ার্কিং সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণাই নেই। তাদের নিজেদের মধ্যে কোনো মহিলা ক্লাব বা অন্য কোনো সাংগঠনিক কাঠামো নেই। প্রায় অর্ধেক উত্তরদাতা নারী (৫০.১২%) ক্ষুদ্র ঋণের সমিতির সদস্য। কিন্তু এর বাইরে তাদের নিজেদের কোনো সংগঠন নেই।
২.১০ আইন ও অধিকার সম্পর্কে ধারণা
কোনো উত্তরদাতাই মৎস্য খাত সম্পর্কিত কোনো আইন বা নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে জানেন না। ৭৩% উত্তরদাতার ধারণা তাদের সুরক্ষার জন্য নিশ্চয়ই কোনো আইন আছে। ২৩% বিশ্বাসই করেন না নিরন্তর সংগ্রাম থেকে তাদের রক্ষা করার মতো কোনো আইন আছে। তবে, এখন পর্যন্ত কোনো উত্তরদাতা নিজের পক্ষে কখনও আইনের আশ্রয় নিয়েছেন।

ষষ্ঠ অধ্যায়
নীতি পরিবর্তনের জন্য সুপারিশমালা

স্টাডির তথ্য সংগ্রহ, গ্রন্থ পর্যালোচনা, প্রাপ্ত ফলাফল নিয়ে আয়োজিত কর্মশালাসমূহে যেসব সুপারিশ উঠে আসে তার সারসংক্ষেপ নিচে প্রদান করা হল।
১. সার্বিকভাবে জলকৃষিতে জেন্ডারভিত্তিক পৃথকীকৃত তথ্য জরুরি ভিত্তিতে প্রকাশ করা দরকার। কারণ এ খাতে বহু সংখ্যক নারী যুক্ত আছেন কিন্তু তাদের অবদান ও অবস্থার কথা ব্যাপকভাবে অস্বীকৃত।
তথ্যসমৃদ্ধ, কার্যকর ও লক্ষ্যভিত্তিক নীতি প্রণয়ন এবং প্রকল্প পরিকল্পনার জন্য সংখ্যাতাত্ত্বিক ও গুণতাত্ত্বিক তথ্য খুবই জরুরি যা জলকৃষি খাতে জেন্ডারভিত্তিক সমতা বিধান, অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং স্থায়িত্বশীল চর্চা উৎসাহিত করতে পারে। গবেষণা ও পরিকল্পনা প্রণয়নে সহায়তার জন্য উন্নয়ন সংগঠনগুলোকে অবশ্যই জেন্ডার বিষয়ক পৃথকীকৃত তথ্য ও উপাত্ত তৈরি করতে উৎসাহিত করতে হবে। সময়ের সাথে ও অবস্থান ভেদে নিয়ত পরিবর্তন হয় বলে জেন্ডার সম্পর্ক, নারীর কাজ ও ক্ষমতায়ন অনুধাবনের জন্য জলকৃষি সংক্রান্ত প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে প্রকল্পের আগে, চলাকালিন ও পরবর্তী সময়ের জেন্ডার সংক্রান্ত তথ্য বিশ্লেষণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিষ্ঠানসমূহের উচিত এমন গবেষণায় সহায়তা করা যাতে তা জলবায়ু পরিবর্তন, ভ্যালু চেইন এবং বাজার, শিল্পায়ন এবং প্রযুক্তিগত পরিবর্তন ইত্যাদির জেন্ডারভিত্তিক প্রভাবের সুক্ষ্ম পার্থক্যগুলো গবেষণায় তুলে ধরতে পারে (ডববৎধঃঁহমব, ২০১০)।
২. সরকারি প্রতিষ্ঠান এবং সংশ্লিষ্ট মৎস্য (বা সম্পর্কিত) উন্নয়ন সংগঠনকে অবশ্যই মানদন্ড, নীতিমালা এবং বাজেট সংক্রান্ত পরিকাঠামো তৈরি করতে হবে যাতে এর ফলে মৎস্য খাতে জনসমক্ষে ও ব্যবসা বাণিজ্যে নারীর সক্রিয় অংশগ্রহন বৃদ্ধি পায়।
উদাহরণ স্বরূপ, এমন জেন্ডার নীতিমালা থাকতে হবে যা জলকৃষি খাতে নারী কর্মীদের সংগঠন বা সমবায়কে স্বীকৃতি দেয় ও তা গঠন করতে সহায়তা করে; একসাথে ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমে অংশগ্রহনকে উৎসাহিত করে; যা তাদের যথাযথ কর্মপরিবেশ প্রদান করে; যা তাদের কাছে জেন্ডার বিষয়ক তথ্য আরো বেশি করে সরবরাহের পথ প্রশস্ত করে; এবং যা নারীদের জন্য বাজার, জেন্ডার বান্ধব প্রযুক্তি, সম্প্রসারন, ইনপুট এবং জলকৃষির বিভিন্ন বিষয়ে দক্ষতা অর্জন ইত্যাদিতে প্রবেশাধিকার সহজ করে তোলে।
৩. মৎস্য ও জলকৃষি শিল্পে কর্মসংস্থান চর্চায় নারীর প্রতি বৈষমমূলক ব্যবস্থা চিহ্নিত করা ও তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থার বিধান করা।
সরকার, প্রাইভেট খাত, নারী ও পুরষ শ্রমিকদের সংগঠন- সকল পক্ষের অংশগ্রহনে বিশেষ করে মৎস্য ও চিংড়ি প্রক্রিয়াকরণ শিল্পে নিরাপদ ও শালীন কর্মপরিবেশ ও ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণের লক্ষ্যে আইন ও নীতি প্রণয়ন করা ও কার্যকর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা জারি করতে হবে, যাতে সকলে এটি মেনে চলতে বাধ্য হয়। উন্নয়ন সহযোগিদের গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে যে, দরিদ্র নারী ও শিশুদের প্রতি বৈষম্যমূলক চর্চা শুধু নীতি নির্ধারকদের অবস্থানই প্রশ্নবিদ্ধ করে না বরং জেলে পরিবারের স্থায়িত্বশীল জীবিকাকে ঝুঁকিপূর্ন করে এবং এই খাতের অর্থনৈতিক সাফল্যকে কলঙ্কিত করে।
৪. জলকৃষি সংক্রান্ত প্রকল্প এমনভাবে ডিজাইন করতে হবে যাতে সেগুলো নারীর বিদ্যমান অবস্থানকে চ্যালেঞ্জ করে, অপরিবতর্নীয় পরিস্থিতি বলে মেনে না নেয়।
কর্মসূচির জন্য এমনভাবে পরিকল্পনা করতে হবে যাতে তা অসমতাভিত্তিক ক্ষমতা সম্পর্ক পরিবর্তন করে এবং নারীর সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও শারীরিক ক্ষমতায়নের দিকে লক্ষ্যস্থির করে। বিশেষ করে, গৃহীত প্রকল্প নারীর উপর কী প্রভাব ফেলবে এবং একই সাথে কিভাবে এর ফলাফলগুলো জেন্ডার সম্পর্ককে প্রভাবিত করবে তা নিরূপণ করতে হবে।
৫. জলকৃষি খাতে কর্মরত উন্নয়ন সংস্থাগুলোর উচিত তাদের গৃহীত কর্মসূচির ব্যাপারে নারী ও পুরুষদের সাথে পরামর্শ করা যাতে তা তাদের কাঙ্খিত চাহিদার সাথে মেলে এবং সবচেয়ে অসহায় গোষ্ঠীর বাদ না পড়া নিশ্চিত করে।
ক্ষুদ্র ঋণ প্রতিষ্ঠানের উচিত মৎস্য খাতে কর্মরত নারী ও পুরুষের জন্য জেন্ডার বান্ধব ‘মৌসুমি ঋণ’ চালু করা, যাতে তারা দীর্ঘ সময়ের জন্য বড় ঋণ নিতে পারেন এবং যেখানে সাপ্তাহিক কিস্তির বাধ্যবাধকতা থাকবে না। নারীর প্রযুক্তি ব্যবহার, আর্থিক ও ব্যবসায়িক ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি সংক্রান্ত ব্যবহারিক জ্ঞান বৃদ্ধি হচ্ছে আরেকটি ক্ষেত্র যার জন্য জরুরি মনোযোগ প্রয়োজন। শিথিল সময়, জেন্ডার বান্ধব কর্মী ও আচরণ সমৃদ্ধ ব্যবস্থায় এলাকাভিত্তিক প্রশিক্ষণ আয়োজন করা দরকার। নারী জেলে এবং কর্মীরা পুরুষ দ্বারা শারীরিক নিপীড়নের শিকার হন। এটি প্রতিহত ও সীমিত করতে স্থানীয় পর্যায়ে তাদের নিজেদের সুরক্ষা সংগঠন গড়ে তুলতে সহায়তা করা, যার মাধ্যমে তারা উপকৃত হবেন।
৬. মৎস্য খাতের স্থায়িত্বশীল প্রবৃদ্ধির জন্য কার্যকরভাবে জেন্ডার সমতা উৎসাহিত করা বিশেষ প্রয়োজন। এজন্য পরিপ্রেক্ষিত ও স্তর অনুযায়ী জেন্ডার সংবেদনশীলতা ও জেন্ডার ক্ষমতায়ন বিষয়ক প্রশিক্ষণ আয়োজন করতে হবে।
মৎস্য খাতে কর্মরত নারী ও পুরুষ কর্মীদের জন্য এই প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। নারী মৎস্য খামারী, তাদের পরিবারের পুরুষ সদস্য, তার কর্মী এবং বাজারের এজেন্টরাও এতে অংশ নেবে। পাশাপাশি, সরকারি অফিসের কর্মকর্তা/ কর্মচারি, এনজিও এবং সিবিওদের মধ্যে যারা তাদের কাজ করেন- তারাও অংশ নেবেন।



আমাদের ফেসবুক পাতা




প্রয়োজনে কল করুন 01740665545

আমাদের ফেসবুক দলে যোগ দিন







Translate »